লখনউ হইতে কুশীনগর অধিক দূর নহে। ৮ তারিখ হইতে ১২ তারিখ তো অধিক দিন নহেই। তবু উত্তরপ্রদেশের শাসককুলতিলককে দেখিয়া মনে হয়, বহু যুগের আত্মবিস্মরণের ওপার হইতে তিনি কথা বলিতেছেন। সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখ আসাদুদ্দিন ওয়েইসির বক্তব্য শুনিয়া অন্যান্য বিজেপি নেতার সহিত গলা মিলাইয়া মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলিলেন, সেই রাজ্যের আর রেহাই নাই, ওয়েইসিরা এখন সেই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বন্যা বহাইয়া দিতেছেন! ওয়েইসির মুখে উত্তরপ্রদেশের মুসলিমদের পাশে থাকিবার বার্তা শুনিয়া ঘাড় নাড়িয়া বিষাদবিহ্বল আদিত্যনাথের আক্ষেপ: যে দিকেই ওয়েইসি তাকান, সেই দিকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়াইয়া পড়ে। মাত্র চার দিন কাটিতে না কাটিতেই কুশীনগরে গিয়া ১২ তারিখ সেই যোগী আদিত্যনাথেরই কণ্ঠে ধ্বনিত হইল ‘আব্বাজান’-এ পুত্রকন্যাদের অধিক রেশন পকেটস্থ করিবার কথা। আদিত্যনাথের অজানা থাকিবার কথা নহে যে, ভারতে কোথাওই ধর্মীয় ভিত্তিতে রেশন বিতরিত হয় না; মুসলিমরা হিন্দুদের অপেক্ষা বেশি রেশন লইতেছেন, এমন তথ্য খুঁজিয়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকিয়াও তিনি এমন ভিত্তিহীন বিদ্বেষবিষাক্ত বার্তা ছড়াইতেছেন, নিয়মিত ভাবে মুসলিমবিদ্বেষের মণিমুক্তা তাঁহার বাণী ও বার্তায় ধ্বনিত হইতেছে। আবার, সুযোগ পাইলে তিনিই অন্যদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলিতেছেন: বিষাক্ত রাজনীতির সহিত ক্লেদাক্ত মানসিকতার এ এক আশ্চর্য মিশেল।
অথবা, হয়তো আশ্চর্যের কিছু নাই। যোগী আদিত্যনাথরা হিন্দুত্বের বিষ ছড়াইতে নামিয়া নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেন যে, অপর দিকে ওয়েইসির ন্যায় অসহিষ্ণু মুসলিম নেতারা থাকিলে তাঁহাদের বিস্তর সুবিধা। পরস্পরকে জায়গা করিয়া দিলে পরস্পরের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি হুহু করিয়া বাড়িবেই। হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা যে পরস্পরের বিশেষ জোরের জায়গা, ইহা ইতিহাস বারংবার প্রমাণ করিয়াছে। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির ঐতিহ্যও এই সত্যকে জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করিয়া চলিতেছে। আবারও সামনে বিধানসভার নির্বাচনের দুন্দুভি, আবারও সেই ঐতিহ্য স্বগৌরবে আত্মপ্রকাশ করিতেছে।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী প্রচার শুরু হইলে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ছবিটি সর্বগ্রাসী হইবে— আর্থিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায় বা সুবিচার, কোনও কিছুই রাজনৈতিক আখ্যানে বড় জায়গা পাইবে না, তাহা প্রত্যাশিতই ছিল। অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি যদিও বা সাম্প্রদায়িক তাসটি নানা রকম হিসাব কষিয়া খেলে, উত্তরপ্রদেশে তাসটির প্রথমেই বাহির হইবার কথা। দেশের বৃহত্তম প্রদেশটি জনসংখ্যার বিচারে সংসদে সর্বাধিক সংখ্যক জনপ্রতিনিধি পাঠাইয়া থাকে, এবং সেই দিক হইতেই তাহার বিধানসভার গঠনটিও দিল্লির শাসকের নিকট জরুরি হইয়া দাঁড়ায়। এমন একটি গুরুতর রাজ্যে, যেখানে পঁচিশ শতাংশেরও বেশি মুসলিম— বিজেপি অন্য কোনও দিকে না তাকাইয়া মেরুকরণের বহুপ্রমাণিত জাদুতেই কেল্লা ফতে করিতে চাহিবে বলিয়াই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনুমান করেন। সেই অনুমান ইতিহাসের প্রমাণে প্রতিষ্ঠিতও বটে। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনটিতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটিয়াছিল। এমনকি মুজফ্ফরনগর ও শামলিতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাও যথাসময়ে সংঘটিত হইয়াছিল। এই বৎসর শাসক দলের অতিরিক্ত অশান্তির কারণও দৃশ্যমান: সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত ও মিউনিসিপ্যাল ভোটে বিরোধীদের অভিযোগ, প্রবল হিংসার বাতাবরণেই বিজেপির জয় আসিয়াছে। সব মিলাইয়া অনুমান করা চলে যে, দিল্লির সবুজ সঙ্কেতেই যোগী আদিত্যনাথ আরএসএস-বিজেপির পুরাতন যুদ্ধকৌশলে আস্থা রাখিতেছেন, এবং রাখিবেন।