Economy

পতন ও মূর্ছা

বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা— ক্ষমতায় এলেই ডলারের দামকে বেঁধে ফেলবেন ৪০ টাকার নীচে। হায়! জনস্মৃতি তা হলে ততখানিও ক্ষীণ নয় যে, দশ বছর আগেকার এ সব ‘জুমলা’ সবাই ভুলে যাবেন।

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:১৩
Share:

হাওয়ায় এখন মহম্মদ রফির গান ভাসছে— ‘ক্যা হুয়া তেরা ওয়াদা’! ডলারের দাম ৯০ টাকার গণ্ডি অতিক্রম করল। আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক: এর আগে কখনও আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার দাম এতখানি কমেনি। ফলে, অনেকেই সমাজমাধ্যমে শেয়ার করছেন তৎকালীন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভিডিয়ো, যেখানে তিনি বলছেন, “অন্য কোনও দেশের মুদ্রার দাম যদি এমন ভাবে না কমে, ভারতের টাকার দাম কমছে কেন? দেশের শাসকদের কাছে সাধারণ মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর দাবি করছেন।” বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা— ক্ষমতায় এলেই ডলারের দামকে বেঁধে ফেলবেন ৪০ টাকার নীচে। হায়! জনস্মৃতি তা হলে ততখানিও ক্ষীণ নয় যে, দশ বছর আগেকার এ সব ‘জুমলা’ সবাই ভুলে যাবেন। ভিডিয়োর নরেন্দ্র মোদীর প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী? যে ভাবে তিনি পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি চল্লিশ টাকায়, বা এলপিজি সিলিন্ডারের দাম চারশো টাকায় নামিয়ে আনার, অথবা যে ভাবে বিদেশ থেকে কালো টাকা ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক ভারতীয়র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা জমা করার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থতার ব্যাখা দিয়েছিলেন, সম্ভবত সে ভাবেই— অর্থাৎ, অখণ্ড নীরবতার মাধ্যমে। ভারত মেনে নিয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী কোনও প্রশ্নের উত্তর দেন না— বিশেষত, সে প্রশ্ন যদি তাঁর ব্যর্থতা সংক্রান্ত হয়, তা হলে তো মোটেই নয়। তবে, টাকার এই পতন ও মূর্ছার পিছনে নেহরুর কোনও দায় আছে কি না, এখনও জানা যায়নি।

আন্তর্জাতিক বাজারে কোনও মুদ্রার দাম কেন কমে-বাড়ে, তা বুঝতে অর্থশাস্ত্রে মনমোহন সিংহের মতো পণ্ডিত না হলেও চলে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক বাজারের মনোভাব প্রতিফলিত হয় টাকার বিনিময় মূল্যে। গত এক দশকে এই বিনিময় মূল্যের ধারাবাহিক অভিমুখ নিম্নমুখী। এবং, গত এক বছরের ঘটনাক্রম তাকে ত্বরান্বিত করেছে। এই সময়কালে আমেরিকার শুল্কনীতির কারণে ভারত বাণিজ্য সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। বস্তুত, এখন যে বাণিজ্য আলোচনা চলছে, তার মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও চড়া শুল্কের হুমকি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারতের অবস্থান ঠিক কোথায়। এবং, এই একই সময়কালের মধ্যে বিপুল অঙ্কের বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নি ভারত ছেড়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারও ভারতীয় মুদ্রাকে ‘স্টেবল’ শ্রেণি থেকে নামিয়ে ‘ক্রল লাইক’ শ্রেণিভুক্ত করেছে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এখনও স্থিতিশীল তার অভ্যন্তরীণ বাজারের পোক্ত চাহিদার কারণে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের অবস্থা উদ্বেগজনক। এই পরিস্থিতির দ্বিস্তরীয় দায় সরকারের উপরে বর্তায়— এক, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যসঙ্গী নিশ্চিত করা যায়নি; এবং দুই, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির স্বাস্থ্যও এমন উন্নত হয়নি, বা সেই প্রত্যাশাও তৈরি হয়নি, যা দেশে বিদেশি পুঁজিকে ধরে রাখতে পারে।

বস্তুত, টাকার দাম আজ যেখানে নেমেছে, প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতীয় মুদ্রা হয়তো আরও আগেই সেই অতলে পৌঁছে যেত। আইএমএফ-এর সমীক্ষা (আইএমএফ কান্ট্রি রিপোর্ট নং. ২৫/৩১৪) বলছে, ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক টাকার দামকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঠা-নামা করতে দেওয়ার বদলে একটি নির্দিষ্ট স্তরের আশেপাশে বেঁধে রাখতে চেষ্টা করেছে। তার অন্যতম উপায়, ব্যাঙ্কের ভান্ডারে থাকা ডলার খোলা বাজারে বিক্রি করা। এর ফলে সেই ভান্ডার কমেছে, এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতার ক্ষতি করেছে। ভারতীয় মুদ্রার রেটিং হ্রাসের পিছনে এটি অন্যতম কারণ। কেন এমনটা ঘটছে, দেশের নেতারা সে বিষয়ে কিছু বলবেন, জনগণের সেই দুরাশা সম্ভবত নেই। উত্তরে মৌন থাকাই এখন দস্তুর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন