শব্দগুলি শুনতে কাছাকাছি, কিন্তু অর্থে যথেষ্ট আলাদা। নীতি, কৌশল, ফন্দি— কোন শব্দটি কোন ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য, তা কেবল চুলচেরা শাব্দিক বিশ্লেষণ নয়, গভীরতর বিবেচ্য। ভারতের বর্তমান কূটনৈতিক দফতরের কার্যক্রম দেখে এ নিয়ে ধন্দ জাগা স্বাভাবিক। অপারেশন সিঁদুর শেষ হওয়ার পরও বিশ্বমঞ্চে ক্রমাগত চলমান ভারত ও পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিষয়ক দ্বৈরথ। ভারতের বক্তব্য, পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়েই সন্ত্রাসবাদীরা ভারতে বারংবার হামলা চালাচ্ছে, পহেলগাম তার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন। পাকিস্তানের বক্তব্য, ভারতের এই দাবির বাস্তবসম্মত ভিত্তি নেই। ইতিমধ্যে বিবিধ বিশ্বমঞ্চে পাকিস্তানের স্বীকৃতি ও প্রভাব-বৃদ্ধিতে স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানি বয়ানটির গ্রহণযোগ্যতা যথেষ্ট। ইতিমধ্যে ভারতের অভূতপূর্ব কূটনৈতিক দৌত্য দেখা গেল, কিন্তু তাতে কতখানি ফল হল, তা নিয়ে ভারতীয় মহলেই সংশয় প্রভূত। এই পরিস্থিতিতে গত রবিবার থেকে শুরু হওয়া ব্রিকস সম্মেলনে যৌথ বিবৃতিতে পহেলগাম সন্ত্রাসের উল্লেখ রাখতে পারায় ভারতের কিয়ৎমাত্রার কূটনৈতিক সাফল্য— মোদী সরকারকে কিছুটা স্বস্তি দিল। ব্রিকস-ভুক্ত দেশগুলি সমস্বরে ওই হামলার নিন্দা করেছে। তবে এই নিন্দার জোর কতটা, এবং অর্থ কতখানি, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেল, কেননা সম্প্রতি বোঝা গিয়েছে, কার্যক্ষেত্রে ভারতের পাশে দাঁড়াতে কে কতটা রাজি তা নিয়ে দিল্লিও যথেষ্ট অবহিত নয়। মনে রাখতে হবে, ব্রিকস-এর তরফে হামলার কথা বললেও পাকিস্তানের নামটি কিন্তু উল্লেখ করা যায়নি, প্রধানত চিনের নির্বন্ধে। এইটুকু সাফল্যে মনোনিবেশ করাকে ফন্দি বা ‘ট্যাকটিকস’-এর গোত্রে ফেলাই শ্রেয়, ঠিক যেমন দেশে দেশে দূতদল প্রেরণও তা-ই ছিল। সাউথ ব্লককে ভাবতে হবে, এমন ছোট পদক্ষেপ দিয়ে ঠিক কোন বৃহৎ কৌশল বা ‘স্ট্র্যাটেজি’টি তাঁরা তৈরি করতে চাইছেন। কৌশল ঠিক না হলে কিন্তু সমগ্র নীতিই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
কথাটি উঠছে বিবিধ কারণে। ইতিমধ্যেই ভারতের সেনাবাহিনীর তরফে শোনা গিয়েছে একাধারে তিন শত্রুর কথা। ভারতের ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর সিংহ ঘোষণা করেছেন, এক সীমান্তে তিন শত্রুর বিরুদ্ধে ভারতকে লড়তে হয়েছে, পাকিস্তান, চিন ও তুরস্ক। এই প্রথম সেনার তরফে অপারেশন সিঁদুর-এ চিনের উপস্থিতির কথা প্রকাশ্যত বলা হল। সমস্যা এই যে, সন্ত্রাস প্রশ্নে যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্বমত তৈরি করতে হয়, তবে চিন ও তুরস্কের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টি ধোঁয়াশা তৈরি করতে পারে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির এমন সুযোগ হারাতে চাননি, জানিয়েছেন যে পাকিস্তান এমন কোনও অক্ষ তৈরি করে ভারতের উপর আক্রমণ শাণাতে আদৌ ব্যস্ত নয়। এই অভিযোগ তুলে ভারত আসলে বিশ্ব-সহানুভূতি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। প্রচারমাধ্যমে বড় বড় কথা বলে বা ‘মিডিয়া রেটরিক’ দিয়ে সত্যকারের সমস্যা সমাধান করা যায় না, ভারতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে আসিম মুনির আবারও জোরদার চেষ্টা করছেন, পশ্চিমি দেশসমূহের চোখে পাকিস্তানকেই দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরতে।
পাকিস্তানের এই ‘কৌশল’ নতুন নয়। বেশ কয়েক দশক ধরেই পাকিস্তান নানা আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের নির্ভরযোগ্য শক্তি এবং ভারতকে আক্রমণাত্মক শক্তি হিসাবে প্রমাণ করতে ব্যস্ত। সাম্প্রতিক শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন বা এসসিও-র যৌথ বক্তব্যে সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ না রাখতে পারায় ভারতকে এই জন্যই পিছু হটতে হয়েছে। ঐতিহ্যগত ভাবেও উপমহাদেশীয় অঞ্চলে পাকিস্তানই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের পছন্দের দেশ, এমনকি ৯/১১-পরবর্তী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সময়েও পাকিস্তানই ছিল ভিত্তিদেশ। বাস্তবিক, পহেলগাম-পরবর্তী বাস্তব বুঝিয়ে দিচ্ছে যে কৌশলের দিক দিয়ে দিল্লি আর ইসলামাবাদের এখনও কতটা তারতম্য।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে