গত কয়েক বছরে ভারতের রাজনৈতিক আবহ কতখানি পাল্টেছে, তার সাক্ষাৎ প্রমাণ এসআইআর। এর সঙ্গে অনেকেই এনআরসি-র তুলনা টানছেন। তুলনার সঙ্গতি-অসঙ্গতিকে পাশে সরিয়ে রেখে বলা যায়, ২০১৯ সালের অসম রাজ্যে এনআরসি কার্যক্রম দেখে কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে দেশে নাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করার দায়টি সম্পূর্ণত বর্তেছে ব্যক্তি-নাগরিকের উপরেই, যা কোনও গণতন্ত্রের দস্তুর হতে পারে না, বিশেষত ভারতের মতো দরিদ্র, অনুন্নত, বহুলাংশে শিক্ষালোক-বঞ্চিত দেশে তো নয়ই। এনআরসি-র বিকল্প নাম হয় ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব ক্রুয়েলটি’। অথচ প্রায় একই ভাবে ২০২৫ সালে যখন ব্যক্তির উপর চাপানো হয়েছে নিজেকে ভোটার হিসাবে প্রমাণ করার কঠিন বিধিবিধান, এবং সেই পরীক্ষায় চুলমাত্র স্খলনেই চলছে ডিসএনফ্র্যানচাইজ়মেন্ট বা ভোটার-পরিচিতি প্রত্যাহারের পালা— তখন কিন্তু সমালোচনা বা বিরোধিতা তুলছে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শিবিরই। যেন, এই কার্যক্রমের যে কোনও সমালোচনাই আসলে রাজনৈতিক অভিসন্ধি-প্রসূত। প্রশ্ন উঠছে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন তো দেশে প্রথম বার হচ্ছে না, তবে আপত্তি কিসের। আপত্তির বিষয়গুলি বিস্তারে ও গভীরতায় বিপুল, যা রাজনৈতিক অবস্থান নিরপেক্ষ ভাবেই তোলা দরকার। এ দিকে সেগুলি যেন স্বীকৃতিহীন, কেননা বিহারের পর বারোটি রাজ্যে ‘এসআইআর পর্ব ২’ এগিয়ে চললেও সর্বোচ্চ আদালতে তোলা আপত্তিগুলির কোনও মীমাংসা হয়নি। নির্বাচন কমিশনও কোনও সন্তোষজনক উত্তর দেওয়ার দায় বোধ করেনি। যেন ধরে নেওয়া হয়েছে, এই কার্যক্রমের গতি আর সাধারণ মানুষের দুর্গতি, দুই-ই সমান্তরাল, কোনওটির কোনওটিকে প্রভাবিত করার কথা নয়।
এসআইআর নিয়ে আপত্তি কিসের— স্পষ্টাক্ষরে জানানো জরুরি। প্রথমত, সাধারণ বোধই বলে দেয়, এত কম সময়ে এত বড় কার্যক্রম সমাধা করা অসম্ভব। আগের কোনও এসআইআর এত দ্রুত সম্পন্ন করা হয়নি। ২০০২ সালের শেষ এসআইআর নিয়ে তাই এমন প্রবল উদ্বেগও তৈরি হয়নি। এ বারে ভোট আসন্ন বলেই তাড়া, অর্থাৎ, সম্ভবত, তাড়াটি রাজনৈতিক। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে জরুরি যে কাজ— জনশুমারি, সেটাই ভারতে বহু বছর ধরে পড়ে আছে। অথচ এ ক্ষেত্রে এত তাড়া? তৃতীয়ত, যে দেশে পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ক অনেক সময়েই নথিভিত্তিক নয়, এবং স্থানিক অবস্থানও বহু ক্ষেত্রে নথিভিত্তিক নয়, সেখানে এসআইআর কেন এই বিষয়গুলির উপর এতখানি নির্ভরশীল? চতুর্থত, ভুয়ো ও মৃত ভোটারদের নাম বাতিলের পাশে বহু যথার্থ নাগরিকের নাম বাদ পড়ছে, প্রমাণিত। কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলির যথাযথ মীমাংসার আগেই সংশোধিত তালিকা প্রকাশ ও তার ভিত্তিতে ভোট সম্পন্ন হয়ে যাবে। এ কি গণতন্ত্র-সম্মত?
উদ্দেশ্য কি তবে ভোটার-পরিচিতি প্রত্যাহারের মাধ্যমে কিছু অঞ্চলে ভোটার মানচিত্র পাল্টানো? এটি পঞ্চম ও গুরুতর প্রশ্ন। নতুবা আগে থেকেই ‘এত লোকের নাম বাদ যাবে’ বলে শাসক দলের প্রতিনিধিরা প্রচারে নামছেন কেন? কেনই বা বিহারে বিরোধী দলের কর্মীদের নাম বাদ দিতে চেয়ে বিজেপি নেতা চিঠি লিখেছেন? ষষ্ঠত, আধারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের পর এখন হঠাৎ কমিশনের মতে, আধার ব্যতীত অনলাইনে ফর্ম পূরণ করাই যাবে না? মানুষকে ভোগানোই কি তবে লক্ষ্য? সপ্তমত, বিএলও-বিএলএ’দের যথেষ্ট প্রশিক্ষিত না করেই স্বল্প সময়ে তাঁদের উপর অস্বাভাবিক ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ একটিও ভুল হলে মর্মান্তিক ফল ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকেই। এ কি ন্যায়সঙ্গত? শেষত, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে প্রায় হুমকির সুরে জানিয়েছে, সতর্ক না হলে বিপদ। নাগরিককে এমন ভীতিপ্রদ সুরে সতর্ক করার কাজটি একমাত্র ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রই করে থাকে। ভারত কি সত্যিই গণতন্ত্রের পথটি ছেড়ে অন্য রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে?
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে