Tirath Singh Rawat

প্রকল্প রাজনৈতিক

এই দেশে, দীর্ণ হউক বা সুষ্ঠু, জিনস পরিবার অধিকারের জন্য সমাজের কাকা-জেঠাদের বিরুদ্ধে বহু লড়াই করিতে হইয়াছে নারীসমাজকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২১ ০৬:৪৪
Share:

—ফাইল চিত্র।

এক কালে দেশনেতা ‘নিয়তির অভিসার’-এ যাইবার কথা বলিয়াছিলেন। স্বাধীন, সংস্কারমুক্ত, উদারমনস্ক, আধুনিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাইয়াছিলেন। অধুনা নেতাগণের সমাজবীক্ষা পাল্টাইয়াছে। ক্ষমতাপীঠে বসিয়াই উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তীরথ সিংহ রাওয়ত সকল সমস্যার ‘মূল কারণ’ বুঝাইয়াছেন— ‘কাঁচির সংস্কার’। সেই কাঁচি, যাহা বসন কর্তন করে। এবং সেই কর্তিত বসন, যাহার চূড়ান্ত উদাহরণ দীর্ণ জিনসের প্যান্ট, তাহাই সকল সঙ্কটের কারণ; লক্ষণও বটে। আর, বসন ক্রমাগত কর্তন করিলে যাহা হয়— ‘নগ্নতার পথে ধাবমান’ দেশের যুব সম্প্রদায়। উক্ত পথ অনুসরণের কারণ? ‘পশ্চিমিকরণের পথে উন্মত্ত দৌড়’। উন্মুক্ত হাঁটু তাই মাদকদ্রব্য গ্রহণের সহিত সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তীরথ-ভাষণের বিবরণ দীর্ঘ করিয়া লাভ নাই, বরং তাহার কারণ অন্বেষণ জরুরি। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই মিলিবে ফ্রয়েড আর ইয়ুং সাহেবের তত্ত্বে, কিন্তু সামাজিক ব্যাখ্যা কেবল তত্ত্বে পাওয়া যাইবে না, সমাজে মেয়েদের সমানাধিকারের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসও বিবেচ্য। কেননা, দীর্ণ জিনস পরিহিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক মহিলা কর্মীই রাওয়ত-বচনের প্রত্যক্ষ কারণ।

Advertisement

এই দেশে, দীর্ণ হউক বা সুষ্ঠু, জিনস পরিবার অধিকারের জন্য সমাজের কাকা-জেঠাদের বিরুদ্ধে বহু লড়াই করিতে হইয়াছে নারীসমাজকে। পুরুষতন্ত্র বারংবার নারীকে নির্দিষ্ট পোশাক ও শৈলীতে বাঁধিতে চাহিয়াছে। উদ্দেশ্য— সমাজে নারীর ভূমিকাটিও আবদ্ধ রাখা। আপনার পোশাক যদি সামাজিক ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কীর্তির প্রতীক হয়, তবে পুরুষতন্ত্র তাহাতে নারীর অধিকার দেয় কী করিয়া? নারী ও পুরুষ যদি একই ধরনের পোশাক পরিয়া সমরূপ আচরণ করিলে দুইয়ের সামাজিক ভূমিকাও সমান হইতে পারে। উল্লেখ্য, যে নারীরা ক্ষমতার একাধিপত্য ভাঙিতে চাহিয়াছেন বা পারিয়াছেন, তাঁহাদের অনেকেই সচেতন ভাবে ‘নারীসুলভ’ চিহ্নগুলি বর্জন করিয়াছেন। তাহা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, এক বিবৃতিস্বরূপ— ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ। বুঝা যায়, পোশাক এবং অধিকারের এই অমোঘ যোগটিই রাওয়তের মন্তব্যে প্রতিফলিত। উহা পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যকামী স্বর। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ব্যাখ্যাত হইতে পারে মন্ত্রিসভার সদস্য গণেশ জোশীর মন্তব্যে। তাঁহার মত, পরিবার ও সন্তানের দেখভাল করাই নারীর প্রধান দায়িত্ব; হাঁটু নিমিত্তমাত্র, নারী কী করিতে পারেন বা পারেন না, উহা নির্ধারণের নির্যাসই আছে রাওয়তের বক্তব্যে।

ভারতে রাওয়তের সমমনস্ক নেতাদের সন্নিবেশ পুরুষতন্ত্রের চণ্ডীমণ্ডপটি রচনা করিয়া থাকে। তাঁহারা প্রচার করেন নারীকে সম্পত্তি ভাবিবার, তাহার ‘এজেন্সি’ অস্বীকার করিবার ধারণা— সুনির্দিষ্ট মনুবাদী প্রকল্পের ছক। স্মরণীয়, মধ্যপ্রদেশের নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় নারীকে ‘লক্ষ্মণরেখা’ পালন করিবার উপদেশ দিয়াছিলেন। বাবুলাল গৌড় বলিয়াছিলেন, স্বাধীন জীবনযাপন নারীর পক্ষে ভাল, দেশের পক্ষে নহে। আশ্চর্য নহে, তাঁহাদের ‘মডেল’ রাজ্য উত্তরপ্রদেশ নারী-নির্যাতনে দেশের শীর্ষে। পুরুষ-অাধিপত্যকামী গৈরিক জাতীয়তাবাদ ফুলে-ফলে পল্লবিত হইলে নারী-জীবনের পরিসর নিয়ন্ত্রিত হইবার আশঙ্কা এড়ানো যায় না। রাওয়তের মন্তব্য তাই ক্ষমতা-উন্মাদের আস্ফালন নহে, উপহাসের বস্তুও নহে। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রকল্পের স্পষ্ট স্বাক্ষর তাহাতে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন