কয়েক জন মার্কিন গবেষক আবিষ্কার করিলেন স্মৃতিবর্ধক এক যন্ত্র, যাহা মস্তিষ্কে স্থাপন করা যাইবে। বহু বৎসর ধরিয়া মস্তিষ্কের সংকেত লইয়া কাজ করিবার পর প্রস্তুত হইয়াছে এই ‘মস্তিষ্কের পেসমেকার’। ইহার বৈশিষ্ট্য হইল, মস্তিষ্ক যখন যথাযথ কাজ করিতেছে, তখন এই যন্ত্রটি নিষ্ক্রিয় থাকিবে, কিন্তু যখন করিতেছে না, তখন এই যন্ত্রটি বৈদ্যুতিক স্পন্দন প্রেরণ করিয়া তাহাকে সাহায্য করিবে। অর্থাৎ, যন্ত্রটি নিজে অনুধাবন করিবে, কখন মস্তিষ্ক নূতন তথ্য সংরক্ষণ করিতে বা পুরাতন তথ্য বুঝিতে অক্ষম, এবং তখন কাজ শুরু করিবে। আলঝাইমার্স-আক্রান্ত বা স্মৃতিভ্রংশ-রোগীর ক্ষেত্রে, ইহা প্রবল সুবিধাজনক। মৃগী বা পারকিনসন’স রোগীরও সুবিধা হইবে। এখনও পর্যন্ত কেবল মৃগী-আক্রান্তের উপর পরীক্ষা করা হইয়াছে বলিয়া, যন্ত্রটির প্রকৃত উপকারিতা বা প্রভাব অজানা, কিন্তু শব্দ মনে করিবার ক্ষমতাকে ইহা ১৫% অবধি ইহা বাড়াইয়া দিতে সক্ষম হইয়াছে, যাহা আলঝাইমার্সের প্রায় দুই বৎসরের ক্ষয়ের পূরণ।
মুশকিল হইল, একটি চমৎকার আবিষ্কারকে কেবল রোগ নিরাময়ের কর্মে ছাড়িয়া দেওয়া মানুষ নামক জীবের পক্ষে সম্ভব নহে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করিবে অন্য উদ্দেশ্যে আবিষ্কারটি ব্যবহার করিতে। কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছাত্র হয়তো ইহা নিজ মস্তিষ্কে লাগাইয়া লইবে, পরীক্ষার সকল পাঠ তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ মুখস্থ থাকিতেছে দেখিয়া সহপাঠী ও শিক্ষকগণ অবাক হইয়া যাইবেন। রহস্য জানাজানি হইলে সে বলিবে, যদি স্মৃতি বাড়াইতে ব্রাহ্মী শাক খাওয়া যাইতে পারে, ব্রহ্মতালুতে ঘৃতকুমারীর রস লেপন করা যাইতে পারে, মস্তিষ্কের ভিতর একটি যন্ত্র প্রবিষ্ট করা যাইবে না কেন? তখন নীতি লইয়া গাঢ় তর্ক উত্থাপিত হইবে। সে পড়াশুনা করিতে গিয়া অন্যায় সুবিধা লইতেছে কি না, ইহাকে ‘ডোপ’ করিবার সহিত, অর্থাৎ মাদক লইয়া খেলোয়াড়ের উচ্চ মানের নৈপুণ্য আয়ত্ত করিবার সহিত তুলনা করা যাইবে কি না, সে প্রশ্ন উঠিবে। তাহার পর হয়তো দেখা যাইবে, ক্লাসের সকল ধনী ছাত্রেরা স্মৃতি-উদ্দীপক লাগাইয়া লইল, দরিদ্ররা পাইল না। তখন সরকারের বিরোধীরা আন্দোলন করিবে, প্রত্যেককে ‘ব্রেনবন্ধু’ লাগাইবার জন্য অনুদান দেওয়া হউক! বহু শিল্পী তাঁহাদের সৃষ্টির উন্নতিকল্পে বহু নেশাদ্রব্য গ্রহণ করেন। জেমস জয়েস সম্পর্কে কথিত আছে, তিনি নাকি ভাল করিয়া সিদ্ধ না হওয়া মাংস খাইয়া শুইতে যাইতেন, যাহাতে পেটের গন্ডগোলের ফলে উদ্ভট স্বপ্ন দেখিতে পারেন ও সেইগুলিকে সাহিত্যের রসদ হিসাবে কাজে লাগাইতে পারেন। এলএসডি সেবক বিট-প্রজন্মের কবিরা, বিভিন্ন মাদক খাওয়া গায়ক-বাদকেরা তো সংস্কৃতির কিংবদন্তি-মহল আলো করিয়া রহিয়াছেন। যদি নেশা করিয়া নিজ ভাবনাকে আশ্চর্য পথে দৌড় করাইবার অভ্যাস, সুশিল্প রচনার স্বীকৃত পন্থা হয়, তাহা হইলে মস্তিষ্কে যন্ত্র বসাইয়া শিল্প করিবার অভ্যাসই বা বন্দিত হইবে না কেন? কবি তো তাঁহার সৃষ্ট একটি পঙ্ক্তিও আর হারাইবেন না!
কিন্তু একই বস্তু যুগপৎ আশীর্বাদ ও অভিশাপ হইতে পারে, তাহা মানুষের নিকট পরিচিত ধারণা। মানুষ যদি কেবল স্মৃতিশক্তি বর্ধনের জন্য যন্ত্রটি ব্যবহার করে, তবে সে দ্বিমুখী ফাঁদে পড়িবে। যন্ত্রটি সকল স্মৃতিই গুদাম হইতে পাড়িয়া আনিবে, সুখস্মৃতি ও কুস্মৃতির মধ্যে পার্থক্য করিবে না। অথচ মানুষের স্বস্তিময় জীবনের আবশ্যিক শর্ত: দুঃখকষ্টের স্মৃতিগুলিকে ভুলিয়া থাকা। তাহার মস্তিষ্ক মনে রাখিবার জন্য যত সচেষ্ট, ভুলিবার প্রয়াসেও তেমনই তীব্রতায় রত। মানুষের বিস্মরণের আশ্চর্য ক্ষমতা তাহাকে পরম যত্নে রক্ষা করিয়া চলিয়াছে। অপমানের, ক্ষতির স্মৃতিকে সে ভুলিয়া থাকিতে পারে বলিয়াই, সেই ক্ষতগুলির স্পষ্টতায় ধীরে ক্ষয়ের প্রলেপ পড়িয়া যায় বলিয়াই, গণপ্রহারের শিকার হইবার পরেও সে এক দিন হাসিতে পারে, জননী মারা যাইবার পরেও বনভোজনে যাইতে পারে, নিজের ঘাতক রোগ হইয়াছে জানিয়াও অফিসের ফাইলে মনোনিবেশ করিতে পারে। কিছু কিছু ঘটনার কথা মানুষের মস্তিষ্ক জোর করিয়া অন্ধকারে সরাইয়া রাখে, যাহাতে তাহা কখনও চেতনায় না ভাসিয়া উঠে, যাহাতে সে পুনরায় সেই অাঘাতের সম্মুখীন হইয়া ভারসাম্য না হারাইয়া ফেলে। যদি এই নূতন আবিষ্কারের আয়ুধটি ব্যবহার করিতে গিয়া অমৃতের সহিত বিষও নির্বিচার মন্থনে উঠিয়া আসে, তাহা মানুষ ধারণ করিবে কোন নীলাভ কণ্ঠে? এবং তাহার পর সেই কণ্ঠ দিয়া গান নিঃসৃত হইবে কী রূপে?
যৎকিঞ্চিৎ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ছৌ নাচকে ক্রীড়া তালিকাভুক্ত করতে। ক্রীড়া সচিব বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ওটা খেলা নয়, কিন্তু মমতা বলেছেন, ‘...ওরা যে জাম্প দেয়, সেগুলো খেলার মধ্যেই পড়ে।’ অনেকে মঞ্চে রক-সংগীত গাইতে গাইতেও প্রায় জিমন্যাস্টিক্স করেন। সেটাই বা খেলা নয় কেন? আর ভোটে বিভিন্ন দলের কর্মীরা যে লাঠিখেলা ছুরিখেলা দেখান? ক্রমশ এ রাজ্যে খেলা বাড়ছে। স্পোর্টসে কিসে নাম দিলি? লং জাম্প, ছৌ জাম্প, কুকুর তাড়া করলে ঘৌ জাম্প!