National News

অপরিণত কূটনীতি এবং অবিশ্বাস্য অসৌজন্য!

ভারত এবং পাকিস্তান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরস্পরকে আক্রমণ করতে অভ্যস্ত, নিরন্তর বাগ্‌যুদ্ধেও অভ্যস্ত। সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে বরাবরই পাকিস্তানের তীব্র নিন্দা করে এসেছে ভারত। আর যে কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে বার বার কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপন করে ভারতকে আক্রমণ করেছে পাকিস্তান।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৭ ০০:৫৯
Share:

নরেন্দ্র মোদী ও পাক বিদেশমন্ত্রী খাজা আসিফ। ছবি: সংগৃহীত।

নির্বোধের মতো আচরণ। ভারসাম্যহীন, অপরিণামদর্শী, অপরিণত এবং চূড়ান্ত অসৌজন্যমূলক। ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাস যে আজন্ম-তিক্ত, সে কথা অস্বীকার করা কঠিন। কিন্তু পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রী নিজের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যে মন্তব্য করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে, তা আজন্ম-তিক্ত ইতিহাসটাতেও বেশ বেনজির।

Advertisement

পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রী যদি সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করেন এবং ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেন, তা হলে এই দুই প্রতিবেশীর অত্যন্ত সংবেদনশীল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যে মোটেই ইতিবাচক দিশায় এগোয় না, সে তো সকলেরই জানা। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় সঙ্কট এবং অস্বস্তি নিজের জন্য এবং নিজের দেশের জন্য তৈরি করে রাখলেন খাজা মহম্মদ আসিফ। নরেন্দ্র মোদী ‘সন্ত্রাসবাদী’, এ কথা জানা সত্ত্বেও এত দিন কী ভাবে পাকিস্তানের সরকার কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল মোদীর সঙ্গে, আগামী দিনগুলিতে আসিফ নিজেই বা কী ভাবে কূটনৈতিক সংযোগ রাখবেন এক ‘সন্ত্রাসবাদী’র নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে, এই অস্বস্তিকর প্রশ্ন এখন থেকে প্রতি মুহূর্তে খোঁচা দেবে ইসলামাবাদকে।

কোনও সরকারি মঞ্চ বা আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে পাক বিদেশমন্ত্রী এই মন্তব্য করেননি, সে কথা ঠিক। কিন্তু তাঁর মতো শীর্ষ রাষ্ট্রনেতারা যখন কোনও গুরুতর বিষয়ে মন্তব্য করেন, তখন মন্তব্যের মঞ্চটা নয়, বাণীটাই যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দেয়, তা খাজা মহম্মদ আসিফ নিশ্চয়ই জানেন। অতএব এই মন্তব্যের ফলশ্রুতির দায় তিনি কোনও ভাবেই এড়াতে পারবেন না।

Advertisement

আরও পড়ুন: মোদী সন্ত্রাসবাদী, বিষোদ্‌গার পাক বিদেশমন্ত্রীর

ভারত এবং পাকিস্তান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরস্পরকে আক্রমণ করতে অভ্যস্ত, নিরন্তর বাগ্‌যুদ্ধেও অভ্যস্ত। সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে বরাবরই পাকিস্তানের তীব্র নিন্দা করে এসেছে ভারত। আর যে কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে বার বার কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপন করে ভারতকে আক্রমণ করেছে পাকিস্তান। কিন্তু এই আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ মূলত নয়াদিল্লি বনাম ইসলামাবাদ লড়াই হিসেবেই ধরা দিয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত লড়াই নয়, এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আর এক রাষ্ট্রের লড়াই হিসেবে ধরা দিয়েছে। বাজপেয়ী বনাম মুশারফ বা মনমোহন বনাম নওয়াজ— এই পর্যায়ে নামতে দেখা যায়নি ভারত-পাক চাপান-উতোরকে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সুর আগের চেয়ে অনেকটাই চড়া হয়েছে। কিন্তু পরিণত কূটনীতির রাস্তায় হেঁটে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বরাবর সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন মোদী। তিক্ততা যতই থাক, দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ শেষ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত কিছু কূটনৈতিক সরণিকে যে বিঘ্নহীন রাখতেই হয়, সে কথা জানেন বলেই এই পথে হেঁটেছেন মোদী। কাশ্মীরে সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্তের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানকে তীব্র আক্রমণ করেছেন নরেন্দ্র মোদী, পাল্টা বিবৃতিতে কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু শরিফের নামে মোদী, বা মোদীর নামে শরিফ কটূ-কাটব্য করেননি ভুলেও। পাকিস্তানের বর্তমান বিদেশমন্ত্রী সম্ভবত সে সব দৃষ্টান্তের অর্থই বোঝেননি। অথবা ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে প়ড়ে তিনি দিশাহীন আজ।

রাষ্ট্রপুঞ্জে সদ্য শেষ হওয়া সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উত্তপ্ত হয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের তীব্র বাগ্‌যুদ্ধে। কিন্তু প্রায় একই সময়ে আমেরিকায় বসে পাক বিদেশ মন্ত্রী স্বীকার করেছিলেন, হাফিজ সইদ এবং লস্কর-ই-তৈবা পাকিস্তানের জন্য ‘বোঝা’। সেই ‘বোঝা’ পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য কিছুটা সময়ও চেয়ে নিয়েছিলেন তিনি। যে আমেরিকা আজ ভারতের সুরে সুর মিলিয়ে হাফিজের বিরুদ্ধে প্রবল ভাবে সরব, হাফিজ সইদ এক সময় সেই আমেরিকারই অত্যন্ত ‘প্রিয়পাত্র’ ছিল, এ কথাটাও আমেরিকায় বসেই সকলকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আসিফ।

হাফিজ প্রসঙ্গে আমেরিকাকে তিনি যতই কটাক্ষ করুন, হাফিজকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে মেনে নিয়ে যে তিনি ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানকেই মজবুত করেছিলেন, তা নিয়ে কারও সংশয় নেই। দেশে ফিরে যে তা নিয়ে কট্টরবাদীদের প্রবল তোপের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে, সেও সকলেরই জানা। ঘরে-বাইরে যুগপৎ অস্বস্তি সহ্য করা কঠিন। সেই কারণেই সম্ভবত ক্ষত মেরামতের চেষ্টা করেছিলেন আসিফ। কিন্তু মেরামত করতে গিয়ে ক্ষতস্থানটাকে আদতে আরও বিষিয়ে তুললেন পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রী। কূটনীতি তিনি আদৌ বোঝেন কি না, প্রশ্ন উঠছিল নানা মহল থেকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক ভাষায় আক্রমণ করে আসিফ আরও বড় করে তুললেন প্রশ্ন চিহ্নটাকে।

প্রশ্ন অবশ্য আরও উঠছে। ২০১৫-র ২৫ ডিসেম্বর কাবুল থেকে নয়াদিল্লি ফেরার পথে ভারতের ‘সন্ত্রাসবাদী’ প্রধানমন্ত্রী যখন আচমকা পাকিস্তানের লাহৌর বিমানবন্দরে নামলেন, তখন পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বিমানবন্দর থেকে ওই ‘সন্ত্রাসবাদী’কে স্বাগত জানিয়ে নিজের প্রাসাদে নিয়ে গেলেন কেন? প্রথম প্রশ্ন হল এই। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, ২০০২ সালে গুজরাতের সাম্প্রদায়িক হিংসাই যদি নরেন্দ্র মোদীকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়ার কারণ হয়, তা হলে ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে মোদীর শপথ গ্রহণের সাক্ষী থাকতে নওয়াজ শরিফ নয়াদিল্লি এসেছিলেন কেন? তৃতীয় প্রশ্ন, ভবিষ্যতে এই ‘সন্ত্রাসবাদী’র নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে কোনও কূটনৈতিক বা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বা কর্মসূচিতে কি পাকিস্তান অংশ নেবে? যদি অংশ নেয়, তা হলে কোন নৈতিকতায় ভর করে নেবে? সেটা সন্ত্রাসের সঙ্গে আপোসের আরও একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে ফুটে উঠবে না তো?

সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান কিন্তু অত্যন্ত ঋজু। সন্ত্রাসবাদী হাফিজ সইদ বা সন্ত্রাসবাদী মাসুদ আজহারদের সঙ্গে কোনও কূটনৈতিক সংযোগ রাখার কথা কিন্তু নয়াদিল্লি কল্পনাই করে না। ‘সন্ত্রাসবাদী’ নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে পাকিস্তান একই নীতি নিতে পারবে তো? দেখার অপেক্ষা রইল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন