পাকিস্তান সম্পর্কে সত্য কথা সাফ সাফ বলিবার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে পুরস্কার দিতেই পারেন। দীর্ঘকাল ধরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বিপুল অঙ্কের সামরিক সাহায্য দিয়া আসিতেছে, অথচ সন্ত্রাস দমনে ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডির কোনও সদিচ্ছা নাই, তাহারা আমেরিকার সহিত ‘মিথ্যা ও প্রতারণা’ চালাইয়া আসিতেছে— ট্রাম্পের অভিযোগটি শুনিতে যত রূঢ়ই হউক, তাহার অন্তর্নিহিত যাথার্থ্য উড়াইয়া দেওয়া যায় না। এই ধরনের কথা যে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রথম বলিলেন তাহাও নহে, গত অগস্টেও তিনি অনুরূপ অভিযোগ করিয়া পাকিস্তানকে সতর্ক করিয়াছিলেন— আচরণ সংশোধন করো, নচেৎ মার্কিন সাহায্য বন্ধ হইবে। ইসলামাবাদ মুখে বলিয়াছে, এখনও বলিতেছে, তাহারা সন্ত্রাস রোধের লড়াইয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছে, কিন্তু সেই দাবি বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন। সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানের শাসকরা যথেষ্ট যত্নবান হইলে তাঁহাদের দেশটিতে সন্ত্রাসী হানার পরম্পরা এমন ধারাবাহিক হইত না, সন্ত্রাসের আতঙ্কও এমন প্রবল আকার ধারণ করিত না। পাকিস্তানের কত নাগরিক ও নিরাপত্তারক্ষী সন্ত্রাসবাদের বলি হইয়াছেন, তাহার পরেও আমেরিকা এমন অপবাদ দিতে পারে কোন মুখে— ইসলামাবাদের এই ক্ষুব্ধ নালিশটি সস্তা আবেগে টইটম্বুর, কিন্তু নির্মোহ যুক্তি বলিয়া দেয়, সন্ত্রাসে মদত দিবার ধারাবাহিক রাষ্ট্রনীতিই সে দেশের মানুষকে বিপন্ন করিয়াছে, করিয়া চলিয়াছে। রাষ্ট্রের অন্যায়ের মাশুল দেশের মানুষকে গনিতে হয়, তাহা আর নূতন কথা কী?
সমস্যা হইল, কূটনীতিতে সত্য কথার নিজস্ব মূল্য অকিঞ্চিৎকর। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথা মিথ্যা নহে, কিন্তু তাহার কূটনৈতিক পরিণাম? আপাতদৃষ্টিতে পরিণাম ইতিবাচক। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র ও তাহার প্রধান যন্ত্রী সেনানায়করা ওয়াশিংটনের চাপ অগ্রাহ্য করিতে পারেন না— ২০০১ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশের একটি টেলিফোনের ধাক্কায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ কী ভাবে এক শত আশি ডিগ্রি ঘুরিয়া গিয়াছিলেন, সেই ইতিহাস অবিস্মরণীয়। এ বারেও ট্রাম্পের কঠোর উক্তির সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান হাফিজ সইদের সন্ত্রাসী কারবার শাসনে এক পা অগ্রসর হইয়াছে। ইসলামাবাদ যাহাই বলুক, এই সংযোগকে নিছক সমাপতন বলিয়া মানিয়া লওয়া কঠিন। প্রেসিডেন্টের তিরস্কারের সূত্র ধরিয়া মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ একশো কোটি ডলারের বেশি অঙ্কের সাহায্য বাতিল করিয়াছে, এই চাপও ইসলামাবাদকে সমস্যায় ফেলিবে। নিতান্ত দেখনদারির খাতিরেও পাকিস্তান সন্ত্রাস দমনে কিছুটা সচল হইতে পারে। হইলে, মঙ্গল।
কিন্তু কূটনীতিতে প্রত্যক্ষ ফল অপেক্ষা পরোক্ষ ফল কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাকিস্তান-শাসন পরোক্ষে চিনের হাত শক্ত করিতেছে। চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। চিন বলিয়াছে যে পাকিস্তান তাহাদের ‘সর্ব-ঋতুর বন্ধু’। সুতরাং নূতন করিয়া আমেরিকার কোপে পড়িলে পাকিস্তান চিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় করিবার দিকে মনোনিবেশ করিবে। এশিয়া তথা বৃহত্তর দুনিয়ায় শক্তিবৃদ্ধিতে তৎপর চিন সেই সুযোগ কবজি ডুবাইয়া গ্রহণ করিবে। তাহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বার্থের অনুকূল হইতে পারে না। এবং, ভারতের পক্ষেও তাহা মোটেই মঙ্গলের নহে। নরেন্দ্র মোদীর জমানায়, বহুলাংশে দিল্লির নির্বুদ্ধিতায়, চিন-ভারত সম্পর্কের অবনতি হইয়াছে। অন্য দিকে, রাশিয়ার সহিত পাকিস্তানি-তালিবানিদের সখ্য তৈয়ারি হইতেছে। সব মিলাইয়া পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। চিন-পাকিস্তানের বাড়তি বন্ধুত্ব সেই উদ্বেগ বহু গুণ বাড়াইতে পারে। দিল্লি, সাবধান।