মঞ্চে তখন রাহুল গাঁধী। রামলীলা ময়দানের সমাবেশে এক শ্রোতা। ১৯ এপ্রিল, ২০১৫। ছবি: রয়টার্স।
কৃষকসভার ভাষণেই হোক অথবা সংসদে, রাহুল গাঁধী, তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথম বার, একটা কথাকেই বারে বারে ফিরিয়ে এনেছেন: মোদীর জমি অর্ডিন্যান্স কৃষকের স্বার্থবিরোধী। জমি অর্ডিন্যান্স ঘেঁটে কথাটি তিনিই আবিষ্কার করলেন, এমন দাবি করলে ঘোর মিথ্যে বলা হবে। তিনি যখন অজ্ঞাতবাসে ছিলেন, তখন বারে বারেই এই আপত্তি উঠেছে। রাহুলের কৃতিত্ব, রাজনীতিকদের যা কর্তব্য, তিনি সেটুকু করেছেন। প্রশ্নটাকে হারিয়ে যেতে দেননি।
তাতে কাজ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী যে খানিক হলেও দিশেহারা বোধ করছেন, তার মোক্ষম প্রমাণ এই বাজেট অধিবেশনে রাজ্যসভায় জমি বিলের সংশোধনী পেশ করতে না চাওয়া। ২০১৩ সালের জমি আইনে যে পরিবর্তন করতে প্রধানমন্ত্রী সংসদের অধিবেশন অবধি অপেক্ষা করতে পারেননি, রাতারাতি অর্ডিন্যান্স পেশ করতে হয়েছিল, তার ক্ষেত্রে এই ধীরে চলার নীতি বলছে, প্রধানমন্ত্রী ভয় পেয়েছেন। তিনি দলীয় সাংসদদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, কৃষক এবং গরিব মানুষের জন্য তাঁর সরকার কী কী করেছে। কিন্তু, গোটা বক্তৃতায় এক বারও জমি আইনের প্রসঙ্গটি তোলেননি।
জমি আইনের সঙ্গে সংশোধনী অর্ডিন্যান্সের ফারাক ব্যতিক্রমে। মানে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার পাঁচটি ক্ষেত্রকে আলাদা করে চিহ্নিত করে দিয়েছে, যেগুলোর জন্য অধিগ্রহণ আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো শর্ত প্রযোজ্য হবে না। ক্ষেত্র পাঁচটি হল—জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা, গ্রামীণ পরিকাঠামো ও গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগের প্রসার, পরিকাঠামো, শিল্প করিডর ও দরিদ্রদের জন্য আবাসন। এ ছাড়াও, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে যদি জমি সরকারের হয়, তবে সে ক্ষেত্রটিও এই তালিকায় ঠাঁই পাবে। এই ছাড়ের আওতায় পড়লে জমি নেওয়ার সময় সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে না, ৮০ শতাংশ মানুষের সম্মতি আদায়ের ঝামেলাও পোহাতে হবে না। এবং, এই সব ক্ষেত্রে জমি কতখানি উর্বর, তাতে সেচব্যবস্থা কেমন, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজারও দায় থাকবে না। ২০১৩ সালের আইন বলেছিল, একেবারে কোনও উপায় না থাকলে তবেই উর্বর জমি অধিগ্রহণ করা যাবে। অর্ডিন্যান্স বলছে, ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলির প্রয়োজন হলে সব জমিই সমান অধিগ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে যে ভাবে জমি জবরদখল করে এসেছে এত দিন, সে ভাবেই জমি নিতে পারবে বেসরকারি পুঁজি। তবে সেই জমিতে যে শিল্প হবে, সেটা ‘জনস্বার্থে’ হওয়া চাই। বেসরকারি পুঁজি লাভ করবে বিলক্ষণ, কিন্তু সরকারের খাতায় কলমে জনস্বার্থের কথাটি থাকতে হবে।
জনস্বার্থ বলতে কী বোঝায়, তার নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই। শব্দটাকে নিয়ে জলঘোলা হয়েছে বিস্তর। আদালতও বহুবিধ রায় দিয়েছে। কিন্তু, এখনও অবধি শব্দটাকে বেঁধে ফেলা যায়নি। ফলে, প্রায় যে কোনও প্রকল্পকেই জনস্বার্থ হিসেবে দেখিয়ে দেওয়া যায়। অতএব, এই ছাঁকনিতে কোনও বিনিয়োগ আটকে যাবে, আশা করার কারণ নেই। ফলে, সরকার যে ক্ষেত্রগুলোকে ব্যতিক্রমী বলে দাগিয়ে দিয়েছে, সেই তালিকায় বিনিয়োগকে ঢোকাতে পারলেই স্যোশাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট আর ৮০ শতাংশ মানুষের সম্মতি ছাড়াই জমি নিতে পারবে।
মানুষের সম্মতি ছাড়া জমি নেওয়া যাবে মানে যে কোনও জমিই অধিগ্রহণ করা সম্ভব। বিরোধী রাজনৈতিক দল অথবা ঝোলাওয়ালা অসরকারি সংস্থা, বাধা দেওয়ার সাধ্য হবে না কারও। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক স্যোশাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের বালাই না থাকা। জমির মালিক নন, কিন্তু জমির ওপর নির্ভরশীল, জমি অধিগ্রহণ হলে এমন মানুষদের কতখানি ক্ষতি হবে, সেটা মাপার জন্যই এই অ্যাসেসমেন্টের ব্যবস্থা করা হয়েছিল জমি বিলে। ক্ষতির মাপ অনুযায়ী তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হবে, পুনর্বাসন হবে— তেমনটাই কথা ছিল। মূল্যায়নটিই না থাকলে সেই ক্ষতিপূরণের আর প্রশ্ন থাকে না। ফলে, সরকারের বেছে দেওয়া ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রগুলিতে জমির মালিক ছাড়া অধিগ্রহণ থেকে আর কারও কোনও আর্থিক লাভের সম্ভাবনা থাকল না। ২০১৩ সালের জমি আইন ১৮৯৪ সালের আইন থেকে যে জায়গাদুটিতে পৃথক হতে পেরেছিল, ২০১৪ সালের অর্ডিন্যান্স ঠিক সেগুলোকেই ফিরিয়ে দিল পুরনো জায়গায়। বিনা সম্মতিতে অধিগ্রহণ, এবং জমির ওপর নির্ভরশীলদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করাই জমি অর্ডিন্যান্সের প্রধান দুই চরিত্রলক্ষণ।
প্রশ্ন করতেই পারেন, সব ক্ষেত্রের জন্য তো নয়। মাত্র পাঁচটা ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই এ ভাবে জমি নেওয়া যাবে। উত্তরে একটাই কথা বলার— ব্যতিক্রমগুলোর বাইরে সম্ভবত খুব বেশি কিছু পড়ে থাকবে না আর। পরিকাঠামোর কথাই ধরুন। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বন্দর, খনি, টেলিকম পরিষেবা, সবই পরিকাঠামো। প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইনও পরিকাঠামোরই অঙ্গ। তার সঙ্গে গ্রামীণ পরিকাঠামো যোগ হলে ক্ষেত্রটির ব্যাপ্তি আরও খানিক বাড়ে। শিল্প করিডরের জন্যও প্রয়োজন হবে বিপুল জমি। পাশাপাশি, এই সরকারের দুটো বাজেটে খেয়াল করলে দেখবেন, প্রতিরক্ষা নির্মাণের ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের গুরুত্ব নিয়ে যথেষ্ট শব্দ খরচ করেছেন অরুণ জেটলি। অনুমান করা চলে, আগামী কয়েক বছরে ক্ষেত্রটিতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। সব মিলিয়ে, আগামী কয়েক বছর দেশে যত জমি অধিগৃহীত হবে, তার সিংহভাগ এই ‘ব্যতিক্রমী’ ক্ষেত্রগুলোতেই যাবে। ব্যতিক্রম বাছার ব্যাপারে সরকার বাহাদুর যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে, অস্বীকার করার উপায় কী?
মুশকিল হল, গোটা ব্যাপারটাই এমন রাখঢাকহীন ভঙ্গিতে হয়েছে যে খুব খুঁটিয়ে না দেখলেও পুরো গল্পটা বুঝে নেওয়া সম্ভব। জমি অর্ডিন্যান্সের শ্রেণিচরিত্র নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশই নেই— ওটা বিনিয়োগকারীদের পক্ষে। তাঁরা যাতে বিনা হাঙ্গামায় পছন্দসই জমি পান, এবং তার জন্য যেন বেশি খরচ না হয়, তার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে এই অর্ডিন্যান্স। তাতে জমির মালিকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে, আর জমির ওপর নির্ভরশীলদের একেবারে মারা পড়ার ব্যবস্থা পাকা। কাজেই, বিরোধীরা যখন বলছেন, মোদী বিনিয়োগকারীদের কাছে তাঁর ঋণ শোধ করছেন এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে, গুজরাত মডেলের উদ্ভাবকের আত্মপক্ষ সমর্থনে জোর গলায় বেশি কিছু বলার থাকছে না।
কিন্তু, সত্যিই কি সব বিনিয়োগকারীর কাছে সমান ভাবে ঋণ শোধ করছেন নরেন্দ্র মোদী? নাকি, কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে একটু বেশি সমান? এই প্রশ্নের কোনও নির্দিষ্ট উত্তর নেই, তবে কিছু চমকপ্রদ সমাপতনের কথা বলা যায়। যেমন ধরুন, নরেন্দ্র মোদীর ব্যতিক্রমের তালিকায় পরিকাঠামো জ্বলজ্বল করছে। আর এই মুহূর্তে ভারতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাপের বেসরকারি বিনিয়োগকারীর নাম গৌতম আদানি। তাঁর প্রথম পরিচয়, তিনি নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠতম শিল্পপতি। ভারতে বন্দর ক্ষেত্রে তিনিই বৃহত্তম বেসরকারি বিনিয়োগকারী; তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও তাই। কয়লা আমদানির ক্ষেত্রেও তিনি দেশে এক নম্বর। ২০১৪ সালেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, আগামী কয়েক বছর তাঁর বিপুল বিনিয়োগের পরিকল্পনা। তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ তিনি বর্তমান উৎপাদনের দ্বিগুণ করবেন। বন্দরের পণ্য চলাচলের পরিমাণও দ্বিগুণ করবেন। দেশে কয়লাখনি কিনবেন। লক্ষণীয়, এর সবই কিন্তু সরকারের দেওয়া ব্যতিক্রমের তালিকায় সগৌরব উপস্থিত। কৃষি পরিকাঠামোতেও গৌতম আদানি বেশ রকম উপস্থিত।
কৃষি পরিকাঠামোয় আছেন নরেন্দ্র মোদীর আরও এক অতি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি— মুকেশ অম্বানি। তাঁর রিলায়েন্স ফ্রেশ ভারতের বৃহত্তম সংগঠিত রিটেল। কৃষিক্ষেত্রের পরিকাঠামোয় বিনিয়োগে তাঁর আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। অবশ্য, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ থাকার কথা কৃষ্ণা গোদাবরী বেসিনের প্রাকৃতিক গ্যাস, অথবা পেট্রোলিয়ামের পরিকাঠামোয়। অথবা, ফোর-জি ইন্টারনেট পরিষেবায়। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা সংস্থাটির। অনেক জমি প্রয়োজন হবে, অনুমান করা যায়। সরকারের দেওয়া ব্যতিক্রমের তালিকাটি আর এক বার মিলিয়ে দেখতে পারেন।
কৃষকের জমি শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী তাঁর ঋণ শোধ করছেন কি না, তা রাজনৈতিক তর্কের প্রশ্ন। কিন্তু, তাঁর জমি অর্ডিন্যান্সের গল্পটা যখন বিরোধী রাজনীতিকরা ঠিক এ ভাবে সাজিয়ে দিচ্ছেন আমজনতার দরবারে, তখন তাঁর অস্বস্তি চোখে পড়ছে। বস্তুত, জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রবল উত্থানের পর আর কখনও তাঁকে এত অপ্রস্তুত দেখায়নি।
সেই কারণেই হয়তো অনেকের সন্দেহ হচ্ছে, বিরোধীদের অভিযোগে অনেকখানি সত্যি লুকিয়ে নেই তো?