সদ্য সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত রাজ্যসভার তরুণ সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, আনুষ্ঠানিক বহিষ্কারের আগে, এক সাক্ষাৎকারে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটি তথা পলিটব্যুরোর ‘কোটা’ভিত্তিক (সম্প্রদায় ও লিঙ্গভিত্তিক) গঠনের ও তাঁর বিরুদ্ধে গঠিত কমিশনের ‘অগণতান্ত্রিক’ ও ‘বিদ্বেষমূলক’ আচরণের (যেমন, তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ‘না দেওয়া’র) এবং ব্যক্তিগত পরিসরে ‘হস্তক্ষেপের’ (যেমন, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য জানার চেষ্টা) বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই বিষয়গুলির অনেকটাই সিপিএমের ‘অভ্যন্তরীণ’ রাজনীতির বিষয়, কিন্তু এমন কিছু কিছু প্রসঙ্গ আছে, যা বিশ্বের যে কোনও কমিউনিস্ট দলের গঠন ভিত্তি ও প্রয়োগ-পদ্ধতি বিষয়ে বার বার ওঠা কিছু পুরনো তত্ত্বগত ও ঐতিহাসিক প্রসঙ্গকে নতুন করে উসকে দেয়। এই পরিসরে সেই প্রসঙ্গগুলি ফিরে দেখার খানিকটা চেষ্টা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না, বিশেষত যখন একশো বছর পেরিয়ে রুশ/বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭) বহুমাত্রিক পুনর্বিচার দাবি করছে। ব্যক্তি ঋতব্রত অথবা সিপিএম দল নয়, বৃহত্তর প্রেক্ষিত ও প্রশ্নগুলিই এখানে আলোচ্য।
গত একশো পনেরো বছর ধরে চলা, মার্ক্সবাদী পার্টির তাত্ত্বিক রূপকার হলেন লেনিন। ১৯০২ সালে প্রকাশিত, তাঁর ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ হয়ে ওঠে প্রথমে রাশিয়ার, এবং বিপ্লবের পর, নানা দেশে কমিউনিস্ট সংগঠন ও আন্দোলন চালাতে গড়ে তোলা ‘তৃতীয় আন্তর্জাতিক’ বা ‘কমিন্টার্ন’-এর (১৯১৯) নেতৃত্বে, সব দেশেরই ‘সর্বজনীন’ পার্টি-তত্ত্ব। লেনিনের তত্ত্ব প্রকাশের অর্ধ শতাব্দী আগে লেখা ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে অবশ্য মার্ক্স (ও এঙ্গেলস) অন্য রকম পার্টির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
ইউরোপের নানা দেশে ‘বিপ্লবী’ মহলে সেই সময় বাকুনিন, ব্লাঁকি-র মতো নৈরাজ্যবাদীদের দারুণ দাপট। যার প্রভাবে ‘বিপ্লবী দল’ বলতে তখন অনেকেই বুঝতেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী ছোট গোষ্ঠীর কথা, যারা শ্রমিক শ্রেণির জন্য কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির ‘বাইরে’ থেকে বিপ্লবের কাজ করবে। মার্ক্স এ ধারণা নাকচ করেন। এর পর যখন আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘ বা ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ (১৮৬৪-৭২) প্রতিষ্ঠা হয় তখনও তিনি অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ, চক্রান্তকারী, বিপ্লবীদের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। পার্টি সম্বন্ধে মার্ক্সের চিন্তায় লেনিনীয় ঠাস-বুনোট না থাকলেও, তিনি মোটের ওপর ‘কমিউনিস্ট’ বলতে সর্বহারা শ্রেণির সবচেয়ে অগ্রবর্তী অংশকে বুঝিয়েছেন, যারা কোনও সংকীর্ণ গোষ্ঠী নয়, সব দেশের সর্বহারাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে। এখনকার চেনা ছক— লোকাল থেকে জোনাল, জেলা-রাজ্য হয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি বা পলিটব্যুরো— ক্রমোচ্চ পিরামিডের কোনও ধারণা তখন ছিল না।
কমিউনিস্টদের মধ্যে দলীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার ধ্যানধারণা শুরু হয়ে যায় মার্ক্সের মৃত্যুর ছ’বছর পর, মার্ক্সবাদীদের একান্ত সংগঠন, সমাজবাদী আন্তর্জাতিক বা ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’ (১৮৮৯-১৯১৪) পর্ব থেকেই। নানা দেশের কমিউনিস্ট সংগঠন এতে যোগ দিলেও জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এসপিডি) সাংগঠনিক ও বৌদ্ধিক উভয় দিক থেকেই সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। উন্নত পুঁজিবাদ থেকে সমাজবাদে পৌঁছনো প্রায় ঋতু পরিবর্তনের মতোই ইতিহাসের একটি অমোঘ ঘটনা, এমন বিশ্বাস এই সময়েই গড়ে উঠেছিল। প্রসঙ্গত, পয়লা মে-তে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের কৃতিত্ব এই ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’-এর, আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনেরও। আর একটি তথ্য, উনিশ শতকের ভারতীয় রাজনীতির ‘গ্র্যান্ড ওল্ডম্যান’ দাদাভাই নৌরোজি ১৯০৪ সালে ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’-এর অ্যামস্টারডাম সম্মেলনে যোগ দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেন।
সমস্যার শুরু যখন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ডাকসাইটে (ইহুদি) তাত্ত্বিক নেতা এডুয়ার্ড বার্নস্টাইন ১৮৯৬-এর শেষ দিক থেকে নানা নিবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন ‘সমাজবাদের সমস্যা’ বিষয়ে। ১৮৮০ সালে তিনি লন্ডনে প্রথম বার মার্ক্স ও এঙ্গেলসের সঙ্গে দেখা করেন। ১৮৮৮ সালে এঙ্গেলসের বন্ধু ও সহযোগী হয়ে ওঠেন। ইংল্যান্ডে বসবাসের সময় তিনি ব্রিটিশ ‘ফেবিয়ান’ সমাজবাদের প্রভাবে আসেন, বিশ্বাস করতে শুরু করেন, বিপ্লবী সংঘর্ষে নয়, সমাজবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথে, নানা সামাজিক-আইনি ‘সংস্কারের’ মধ্য দিয়ে। ফলে চাই, চালু মার্ক্সবাদের ‘সংশোধন’। বার্নস্টাইনের রচনা ও পরে ১৮৯৯ সালে তাঁর বই প্রকাশিত হলে তুমুল রাজনৈতিক মত-দ্বন্দ্ব শুরু হল। এসপিডি-র চরমপন্থীরা তাঁর বহিষ্কার চাইলেও, শেষে তাঁর কিছু অনুগামীকে বহিষ্কৃত করা হয়, আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁকে নয়। কিন্তু বিতর্কটা রয়ে গেল এবং ক্রমে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টিতে (আরএসপিডিএল) এক তরুণ মার্ক্সবাদী, ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ— লেনিন নামে যিনি বিশ্বখ্যাত— যোগ দিলে তাঁর তীক্ষ্ণ সমালোচনামূলক রচনায় বার্নস্টাইনের ‘সংশোধনবাদ’, র্যাডিকাল মার্ক্সবাদীদের কাছে গালাগালির সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।
১৯০০ সাল থেকেই প্রবীণ রুশ মার্ক্সবাদী প্লেখানভ এবং মারটভ, ভেরা জাসুলিচ প্রমুখের ও পরে ট্রটস্কির সহযোগিতায় লেনিন প্রথমে মিউনিখ, পরে জেনিভা থেকে আরএসপিডিএল-এর মুখপাত্র ‘ইস্ক্রা’ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অচিরেই মারটভ ও অন্যান্য ‘নরমপন্থী’দের সঙ্গে দলের গঠন ও শৃঙ্খলার প্রশ্নে লেনিনের মতবিরোধ চরমে ওঠে। ১৯০১ থেকেই লেনিন, প্রখ্যাত রুশ লেখক, শেরনিশেভস্কির বিপ্লবী উপন্যাস, ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ (১৮৬৩)-অনুপ্রাণিত হয়ে সমনামে একটি রাজনৈতিক পুস্তিকা লিখতে শুরু করেন, যা প্রকাশ পায় ১৯০২ সালে। ১৯০৩ সালে দলের দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন এই গ্রন্থে প্রকাশিত মতামতগুলি দলের সংগঠন বিষয়ক প্রস্তাব হিসেবে পেশ করেন। প্রথমে প্লেখানভ সমর্থিত লেনিনের এই প্রস্তাব অল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতায় খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু ক্রমে, লেনিন-বিরোধী দুটি গোষ্ঠী— ইহুদি শ্রমিক সংগঠন, ‘বুন্দ্’ ও ‘র্যাবোশাই ডাইলো’ নামে ট্রেড-ইউনিয়নপন্থী পত্রিকার সমর্থকরা— বেরিয়ে গেলে, দলে লেনিনপন্থীরা সংখ্যায় সামান্য ভারী হয়ে যান, সেই জোরে তাঁরা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পার্টি কাউন্সিল দখল করেন এবং সেই সূত্রে ‘বলশেভিক’ (সংখ্যাগুরু) ও ‘মেনশেভিক’ (সংখ্যালঘু) শব্দ দুটি বিশ শতকের ইতিহাসে অমর হয়ে যায়।
লেনিনীয় বীক্ষায়, পার্টি হল পেশাদার বিপ্লবীদের একটি ছোট এবং চরম শৃঙ্খলিত সংগঠন, যা তার ‘সঠিক’ তাত্ত্বিক সচেতনতায় সর্বহারা শ্রেণির চেতনাকে ধারণ করতে সক্ষম, যা সর্বহারাদের পক্ষে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বোঝা অসম্ভব। তাই, শ্রমিক শ্রেণির বা গণ সংগঠনের ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ নয়, পার্টি নেতৃত্বের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে গঠিত সংগঠনযন্ত্রই পারে সর্বহারাদের সমাজবাদী বিপ্লবের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে। লেনিন জানতেন, দলের মধ্যে কেন্দ্রীয় মতের সঙ্গে ‘অন্য বা ভিন্ন’ মতের পার্থক্য ঘটতেই পারে, কিন্তু তাতে বেশি আমল দেননি। তাঁর মতে, তথাকথিত ‘সমালোচনার অধিকার’ আসলে সমস্ত সংহত ও সুচিন্তিত তত্ত্বের (যা পার্টি কেন্দ্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে) কাছ থেকেই ‘মুক্তি’ চায়, তাতে ‘বহুমতের সমাবেশের ধারণা’ ও ‘নীতির দীনতা’ প্রকাশ পায়। এই সূত্রেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের’ নীতি, যা কোনও বিষয়ে (যেমন, ভারতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বিষয়ে) পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের স্থিরীকৃত নীতি নিয়ে দলে সর্বনিম্ন স্তর অবধি আলোচনা চালানো গেলেও শেষ অবধি গৃহীত হবে কেন্দ্রীয় মতটিই।
শুরু থেকেই মাঝেমধ্যেই এই পার্টিতত্ত্ব সমালোচনার মুখে পড়েছে। রোজা লুক্সেমবার্গের মতো নারীবাদী নেত্রী লেনিনকে ‘প্রতিস্থাপনবাদী’ বলেছেন, কেননা, রোজার মতে, লেনিন শ্রেণির জায়গায় এনেছেন দলকে; দলের জায়গায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে (অস্যার্থ, স্বয়ং নিজেকে)। অর্থাৎ, নিজের ভাবনাই হয়ে উঠেছে শ্রমিক শ্রেণির ভাবনা! বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে উঠেছে এই পার্টিতত্ত্বের ভিত্তিতেই, লেনিনের জীবদ্দশায় যার সূচনা, পরে যা আরও ‘উৎকট’ রূপ দেখিয়েছে।
ভারতে সংকটটা আরও প্রকট। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ঘোর অবিশ্বাসী লেনিনের ভাষায় পার্লামেন্ট হল ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’, তাঁর বিশ্বাস বিপ্লবী সর্বশক্তিমান পার্টি সংগঠনে। সিপিএম-সহ বেশির ভাগ বাম দলই অবশ্য সাড়ে ছ’দশক ধরে সংসদীয় রাজনীতির আবর্তেই আটকে রয়েছে, অথচ সংসদীয় দল ও কার্যক্রম এখনও শেষ অবধি নিয়ন্ত্রিত হয় একটি ছোট (সংসদীয় দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে থাকা) কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দ্বারা, যদিও লেনিনের স্বপ্ন— বিপ্লব সংঘটন— থেকে, এই নেতৃত্ব আলোকবর্ষ দূরে! এই সোনার পাথরবাটির মেকিপনা যত দিন না ঘুচবে, তত দিন দল ও তার অন্তরিন অধিবাসীরা বারে বারে হোঁচট খেতেই থাকবে।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক