গ ত ক’দিন ধরে আমরা অনেকগুলো গল্প পড়েছি, দেখেছি, শুনেছি। সে-সব গল্প উঠে এসেছে সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনের পরদায়, দৈনন্দিন আলাপে। উত্তর চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন হিংসার্ত এলাকার সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষের গল্প। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের গল্প। কোথাও তাঁরা দল বেঁধে বহিরাগত দাঙ্গাবাজদের চোখে চোখ রেখে বলেছেন, ‘খবরদার!’ কোথাও দাঙ্গার ভয়ে ঘরবাড়ি ফেলে পালিয়ে আসা অপরিচিত শরণার্থীদের থাকা-খাওয়া-শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেছেন, বিশেষ করে যত্ন নিয়েছেন অন্তঃসত্ত্বাদের। কোথাও বা এলাকার সন্ত্রস্ত পসারিদের অভয় দিয়ে দোকান-বাজারের ঝাঁপ খুলিয়েছেন, যাতে রোজকার জীবন তার নিজের ছন্দে চলতে পারে। এঁরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। কিন্তু বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁরা নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান ভাবেননি, মানুষ ভেবেছেন। মানুষের যা করার কথা, করেছেন। গল্পগুলো তৈরি হয়েছে। সেই সব গল্প পড়ে, দেখে, শুনে আমাদের মন ভাল হয়েছে।
কী হবে এই সব গল্প শুনে, শুনিয়ে? সমাজের পরতে পরতে যে আগুন ছড়িয়ে চলেছে, রাজনীতির কারবারিরা যে আগুনে ভোট সেঁকতে প্রবল উদ্যমে দৌড়োদৌড়ি করছেন, এমন দু’চারটে ভাল গল্প কি তা নেভাতে পারবে?
প্রশ্নটাকে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। বিষবৃক্ষ বাড়ছে ভয়ানক গতিতে, সমাজের মনোভূমিতে অতি দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে তার গরল। গতকাল অবধি যাদের কথা শুনে চিন্তাভাবনায় ঠিকঠাক মনে হত, তারাও অনেকেই আজ হঠাৎ ‘বড্ড বাড় বেড়েছে ওদের’ বলে আস্তিন গোটাচ্ছে। ইতস্তত কিছু মানুষের মনুষ্যত্ব এই ঘোর থেকে ঘোরতর অন্ধকারে আলো দেখাতে পারবে, এমন কথা জোর গলায় বলি, তার সাধ্য কী?
তবু গল্পগুলো থেকে যায়। বৃহত্তর কোনও সত্যের সন্ধান দিতে পারুক বা না পারুক, নিতান্ত গল্প হিসেবেও থেকে যায়। আর, সত্যি বলতে কী, যত দিন যাচ্ছে, বৃহত্তর সত্যের মহিমা যেন ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে। আছে সে-সত্য হয়তো কোথাও, কিন্তু সেই পরমব্রহ্মের পিছনে ছুটতে গিয়ে চার পাশের ছোট ছোট গল্পগুলোকে নজর না করলে আমরা বোধ হয় নিজেদেরই ক্ষতি করব। করছি। সাম্প্রদায়িক দুর্বুদ্ধির মোকাবিলায় অনেক তত্ত্ব পেশ করে থাকি আমরা, অনেক তর্ক তুলি। সে-সবই খুব দরকারি। কিন্তু তার পাশাপাশি দরকারি অনেক গল্প বলা আর শোনা, যে গল্প বহু মানুষের মন ছুঁয়ে যেতে পারে, বহু মানুষের মনে নতুন আলো জ্বেলে দিতে পারে, অনন্ত তত্ত্ব এবং তর্ক যে মনের কাছে পৌঁছয় না। গল্প আর কিছু পারে না, কিন্তু সম্ভাবনা দেখাতে পারে। মহৎ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নয়, স্বাভাবিক থাকার সম্ভাবনা।
যে গল্পগুলো আমরা এই ক’দিন পড়লাম, দেখলাম, শুনলাম, সেগুলো স্বাভাবিক মানুষের গল্প। সেখানেই তাদের জোর। ওই মানুষগুলোকে কেউ ‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে’ বলে কোনও মহতী বক্তৃতা শোনায়নি, তাঁরা অমৃতের পুত্রকন্যা নন, তাঁদের স্বভাবে ও আচরণে নিশ্চয়ই অগণিত মানুষী দুর্বলতা আর ক্ষুদ্রতা অহরহ ধরা পড়ে, যেমনটা আমাদের সকলেরই। কেন তাঁরা অশান্তির মোকাবিলায় একজোট হয়েছেন, কেন তাঁরা দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তার উত্তর খুব সহজ। এমনিতেই তাঁদের জীবনে সমস্যার শেষ নেই, তার ওপরে এই সম্পূর্ণ অকারণ, অবান্তর, উটকো উৎপাত! স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানেই তাঁরা বুঝে নিয়েছেন, এই বদমাশদের একটুও প্রশ্রয় দিলে চলবে না, আত্মরক্ষার তাগিদেই তাদের তাড়াতে হবে, নান্যপন্থাঃ। অতএব, মোমবাতি জ্বালাতে হয়নি, সম্প্রীতির গান গাইতে হয়নি, ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান তুলতে হয়নি, সবাই মিলে বেঁচে থাকার ভরসাই সবাইকে রক্ষা করেছে।
সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে যারা রাজনৈতিক (এবং, অবশ্যই, আর্থিক) ক্ষমতার ফসল তুলতে বদ্ধপরিকর, তারা এই স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানকে ধ্বংস করতে চাইবেই। কিন্তু তাদের প্রতিহত করতে হলে আমাদেরও লোকসমাজের অন্তর্নিহিত কাণ্ডজ্ঞানের মূল্য বুঝতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নাগরিক প্রতর্কে সীমিত না রেখে চিনে নিতে হবে লৌকিক জীবনযাপনের দৈনন্দিনতায়। যে লোকজীবন তত্ত্ব জানে না, স্লোগানের পরোয়া করে না, ইতিহাসের চড়াই-উতরাই পার হয়ে চলে, চলতে থাকে। এবং সেই চলার পথে তৈরি করে অজস্র গল্প।
সম্প্রতি পড়েছি সৈয়দ নাকভি-র লেখা একটি বই। বিয়িং দি আদার। প্রবীণ সাংবাদিকের লেখা বইটিতে অনেক গল্প আছে। স্বাভাবিক মানুষের স্বাভাবিক জীবনের গল্প। একটা গল্প বলি। গত শতকের চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে পূর্ব উত্তরপ্রদেশের মুস্তাফাবাদে শৈশব কেটেছিল লেখকের। সেখানে কোনও নারীর সন্তানসম্ভাবনা সাত মাসে পৌঁছলে শুভকামনায় ‘সোহর’ গাইতে আসতেন গায়িকারা। গানের একটি লাইন ছিল: আল্লা মিয়াঁ, হামরে ভাইয়া কা দিয়ো নন্দলাল।— হে আল্লা, আমার ভাইকে নন্দলাল কৃষ্ণের মতো সন্তান দাও।
গল্পগুলো বাঁচলে, আমরাও বাঁচব।