এ ই সবে শেষ হল বইমেলা। গত কয়েক দিন ধরে পুব দরজার চৌকাঠ পেরোতেই বাঁ-দিকে শিশু সুরক্ষা আয়োগের স্টল। শিশুভাব আনার জন্যই বোধ হয় সামনের দেওয়ালে বেলুন টাঙাচ্ছিলেন বিশ-বাইশের এক জন। সত্তরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন ঈষৎ ন্যুব্জ, কাঁধে ঝোলা ভদ্রমহিলা, যিনি একের পর এক দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। বরাহনগর থেকে তিনি রোজ আসছিলেন নিজের বই বিক্রি করতে। বিগত চব্বিশ বছর ধরেই এই করে আসছেন। গিল্ড অফিসের সামনে দিয়ে নামী কর্মকর্তা প্রকাশকটি প্রায় হিটলারের সামরিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের কায়দায় লেফট-রাইট করতে-করতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। মুক্তমঞ্চে উল্টো টুপি মাথায় গলিয়ে পথে এ বার নামো সাথি গাইবার চেষ্টা করছিলেন যে সুরছুট খ্যাপাটে ভদ্রলোক, তাঁর সামনেও জনা পনেরো ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর মাথায় নিয়ে একাগ্র হওয়ার চেষ্টা করছেন! দুই সদ্য যুবা দুই যুবতীকে পাশে রেখে এমন কায়দায় সেলফি তুলে চলছিলেন, বোঝাই যাবে না ওঁদের আলাপ মাত্র আগের দিন এই বইমেলাতেই।
বিনিপয়সায় এই সব দৃশ্য দেখতে চাইলে, এই সব চরিত্র এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক বুনতে চাইলে অবশ্যই বইমেলা যাওয়ার অর্থ হয়। যদি জানা থাকে আপনার পছন্দের বইটি কত নম্বর স্টলে পাওয়া যাবে, যাওয়া যায়। কিন্তু যে বই-পিপাসু জানতেন না কী বই কিনবেন, অথবা যাঁরা অজানা বইয়ের সন্ধান পেতে চাইছিলেন, তাঁদের কি গিয়ে কাজ হল? কোথায় যে কোন বই পাওয়া যায় তার কোনও দিক-দিশা দেখা যায়নি এই বইমেলায়। মন প্রস্তুত করে আসবার উপায় ছিল না। কী করে বুঝবেন মাইকেল মধুসূদন একাডেমি স্টলে বিক্রি হচ্ছিল বাংলাদেশি রান্নার বই ‘খুনতি কড়াই’! কী করে বুঝবেন বিকল্প শক্তি উৎপাদন এবং ব্যবহার বইটির প্রাপ্তিস্থান ছিল ভোলানাথ প্রকাশনী! বিদ্যাসাগরের প্রিয় ছাত্রকে নিয়ে লেখা বইটি যে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টলে আর লেফটেন্যান্ট সুরেশ বিশ্বাসের জীবনী গ্রন্থটি যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টলে বিক্রি চলছিল, না জানা থাকলে কী করবেন।
একটা উপায় ছিল অবশ্য। এই সব সন্ধান পেতে হলে আপনাকে প্রতি দিন দুপুরে মেলার গেট খুলতে-না-খুলতেই ঢুকে পড়তে হত। প্রায় তেরো একর রঙ্গভূমিতে ছড়ানো-ছেটানো ছয় শতাধিক স্টল ঘুরে-ঘুরে কোমরের দড়ি ছেঁড়বার উপক্রম যখন, একটা হালকা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারত। এক দিনে কি আর অত স্টলে ঘুরতে পারতেন? মনে হয় না। কেন? পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন দেখলেই তো হত। তা হলে আগে থেকে আটঘাট বেঁধে আসা সম্ভব। তা ঠিক। তবে ছয় শতাধিক স্টলের ক’জন বিজ্ঞাপন দেন? যে নামী প্রকাশকেরা বইয়ের খবর জানিয়ে আগাম ঘোষণা-বিজ্ঞাপন দেন, সমস্যা তো সেই সব তালগাছ নিয়ে নয়। ভাববার কথা, যাঁরা নিয়মিত জানান দেন না, দিতে অপারগ, সেই সব মাঝারি, ছোট প্রকাশক, সেই সব খেজুর গাছ নিয়ে। তাঁদের ভাল বইটির খবর আমরা কী করে পাব?
খবর নিতে চেয়েই কলেজ স্ট্রিটের এক মাঝারি প্রকাশকের দফতরে সকালে ফোন করে জিজ্ঞাসা করা গেল, আপনাদের অমুক বইটি কি বইমেলা স্টলে আছে? ওপার থেকে বিরক্ত গলা: বইমেলায় গিয়ে দেখে নিন। হাজার অনুরোধ উপরোধেও ভদ্রলোক বলে চললেন এক কথা। বাধ্য হয়ে বলতে হল, বইটা বিক্রি হলে তো আপনাদের লাভ, এ রকম অবুঝপনা করছেন কেন? ফোন কেটে গেল। এক বন্ধু জানালেন, নামী প্রকাশকের বইমেলা স্টলে ঢুকে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এ বার আপনাদের নতুন বই কী কী? উত্তর এসেছিল, আপনার কোন বই লাগবে জেনে তবে আসা উচিত ছিল। সঙ্গে-সঙ্গে মনে পড়েছিল স্কট লেন পাড়ার সেই ডিগ্রিহীন দোকানি ভদ্রলোকের কথা যিনি উনিশশো পঁয়ষট্টিতে হাতে তুলে দিয়েছিলেন জলপাই রঙের একটি বই। পড়ে দেখো, ভাল লাগবে। দাম? বাবাকে বোলো পরে দাম দিয়ে যেতে। বইটির নাম চাঁদের পাহাড়।
কোনও শিল্পকে এগিয়ে যেতে হলে তার প্রতিটি নাট-বোলটুকে প্রগতি অভিমুখে যাত্রা করবার শিক্ষণ দিতে হয়, না হলে তা বিছানার কারুকাজ-শোভিত চাদর তৈরি করতে গিয়ে জ্যালজেলে গামছা উৎপাদন করে। এই সব প্রস্তুতি না নিয়ে, শুধু ‘বাঙলা বইয়ের আকাল পড়েছে গো’ এমনতর রুদালি-ক্রন্দনে বই-শিল্প এগোবে বলে মনে হয় না।
বইমেলা কর্তৃপক্ষ কোথায় যে কোন স্টল তা খুঁজে পাওয়ার একটা সহজ উপায় বার করেছেন। সুন্দর ম্যাপ বিনামূল্যে বিতরিত। সেই ম্যাপ ধরে চললে ঠিক খুঁজে পাওয়া সম্ভব আচারের দোকান থেকে অনাচারের দর্শন-প্রচারকারী বইবিপণি। এই পথ ধরেই তো মেলা কর্তৃপক্ষ প্রতিটি অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের বইয়ের নাম-দাম দেওয়া নির্দেশিকা প্রকাশ করতে পারতেন। হোক না চারশো পাতার নির্দেশিকা, ক্ষতি কী? হোক না সস্তার কাগজ, অসুবিধা নেই। বিনা পয়সার বাইবেলের মতো বিতরণ না করে অল্প-স্বল্প দাম নিলেও অস্বস্তি হবে না বই-পিপাসুদের। সেই বই পড়েশুনে তখন তৈরি হয়েই যাওয়া যাবে বই কিনতে। (বুকস ইন প্রিন্ট যে বার হয়, তা জানা আছে। কিন্তু ওই জাবদা বই সাধারণের কাজে লাগে না)। আজকাল এই সব কাজে স্পনসর পাওয়া যে শক্ত নয়, তাও তো বইমেলার হোতারা ভালই জানেন। অতএব হাতে থাকে সদিচ্ছা। সেই সৎ ইচ্ছা কী আছে বইমেলার আয়োজকদের? এবং নিষ্ঠা? তা বুঝতে আগামী মেলা অবধি অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।