পাশাপাশি থাকাটা শিখতে হবে

ক্লাস ফোর পর্যন্ত আমি ঘোর আস্তিক ছিলাম। বৈশাখ মাস জুড়ে ভোরবেলা ভক্তি-গদগদ চিত্তে শিবের মাথায় জল দিতাম। ক্লাস ফাইভ থেকে এইট আমার ট্রানজিশন পিরিয়ড।

Advertisement

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:১৮
Share:

ক্লাস ফোর পর্যন্ত আমি ঘোর আস্তিক ছিলাম। বৈশাখ মাস জুড়ে ভোরবেলা ভক্তি-গদগদ চিত্তে শিবের মাথায় জল দিতাম। ক্লাস ফাইভ থেকে এইট আমার ট্রানজিশন পিরিয়ড। এই সময় ‘চতুরঙ্গ’ ইত্যাদি পড়ে ‘প্রচুরতম মানুষের প্রভূততম সুখসাধন’-এর বুলি আওড়াতাম আর নিজেকে নাস্তিক প্রমাণ করার জন্য ছিটকে বেড়াতাম। ক্লাস এইটে পৌঁছে এ রোগের কিছু বাড়াবাড়ি দেখা দিল। স্কুলে শ্বেতকরবী গাছের কোলে বাঁধানো বেদীতে একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দারোয়ানরা। এক দিন বন্ধুদের মধ্যে নাস্তিক বনাম আস্তিক তর্কযুদ্ধের ফলস্বরূপ বন্ধুদের চ্যালেঞ্জ শিরোধার্য করে কয়েক জন সেই শিবের মাথায় জুতোসুদ্ধ পা তুলে দিলাম। দারোয়ানের দল শোকে ভয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। বন্ধুদের চমকে দেওয়ার গর্বে আমাদের বুকের ছাতি ফুলে উঠল।

Advertisement

এর পরের গল্পটা যা হওয়ার ছিল, তা-ই। আমাদের ডাক পড়ল হেডমিস্ট্রেসের ঘরে এবং অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই— এ বিষয়ে সবিশেষ শিক্ষালাভ হল। আজ যখন চারিদিকে রামনবমীর তরবারি ঝনঝন করে বাজছে, হনুমান পুজোর প্যান্ডালে শহর ছেয়ে যাচ্ছে, তখন কেন জানি না, ছোটবেলার এই গল্পটা আমার মনে পড়ল। অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই, ঠিকই, কিন্তু কতটা পর্যন্ত? সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম যখন খাপ-খোলা তরোয়াল নিয়ে সংখ্যালঘুর নাকের ডগায় নেচে বেড়ায়, তখন তো তা প্রতিরোধ করতেই হবে।

প্রশ্ন হল, কী হবে সেই প্রতিরোধের পথ? আর প্রতিরোধ মানেই কি প্রত্যাঘাত? দুর্ভাগ্যজনক ভাবে চার পাশে এখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আর প্রত্যাঘাত গুলিয়ে গেছে। ধর্মের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের যত বোলবোলাও বাড়ছে, ততই আমরা, যারা ক্লাস এইট থেকে নাস্তিকের দল, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছি—‘হু হু, বাওয়া বলেছিলুম না, এই ধর্ম ব্যাপারটাই উঠিয়ে দেওয়া উচিত। আমরা (সর্বজ্ঞের দল) তো কবে থেকেই জানি এই সব ধর্ম-ফর্ম বোগাস!’ আর এক দল বন্ধু বলছেন, ‘না, ধর্ম উঠিয়ে না দিলেও চলবে, অতটা বাড়াবাড়ির দরকার নেই, কিন্তু ওটা যার-যার নিজস্ব, ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাড়ি বসে করলেই তো হয়।’

Advertisement

আর একটা দল আছে, যাঁরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মানেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক নন মোটেই। তাঁদের হয়েছে মহা জ্বালা! তাঁরা এখন নিজেদের ডিফেন্সে ধর্মের ভাল দিক, ধর্ম এবং সংস্কৃতির গলায় গলায় ভাবের কথা তথ্য এবং তত্ত্ব সহযোগে প্রমাণে মরিয়া। এইখানে জনান্তিকে স্বীকার করা ভাল যে, একটা কথা আমার এই সে দিন পর্যন্ত মনে হত, যাঁরা এই সব পুজোআচ্চা করেন, তাঁরা যথেষ্ট ‘প্রগতিশীল’ নন এবং সম্ভবত অন্তরে সাম্প্রদায়িক। এখন অভিজ্ঞতায় মনে হয়, এ দৃষ্টিভঙ্গি খণ্ডিত। গেল বছর যে মেয়েরা দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মুম্বইয়ে হাজি আলি দরগায় প্রবেশের অধিকার আদায় করলেন, তাঁরা কি কম প্রগতিশীল? অথবা পুণের যে মেয়েরা শনি-শিংনাপুর মন্দিরে ঢোকার জন্য মিছিল করলেন, তাঁরা কি সত্যিই সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে লড়াই করলেন? নাকি মন্দিরে নিজেদের পা রাখার দাবি তাঁদের উদ্বুদ্ধ করল?

মানতেই হবে যে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে নানা পিতৃতান্ত্রিক অসম্মান লুকিয়ে থাকে। করওয়া-চওথ, সিঁদুর-খেলা, শিবরাত্রির মতো আচার মেয়েদের দ্বিতীয়-লিঙ্গের অবস্থানে বেঁধে রাখতে চায়। আবার একই সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের অপবিত্রতার ওজরে ব্রাত্য করে রাখাও পিতৃতন্ত্রের আর এক জুলুম। তাই যে মেয়েরা এই অপবিত্রের তকমা খসিয়ে ধর্মস্থানে নিজেদের জায়গা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদের লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই হবে। এই মেয়ের দল কেন নাস্তিক নয়, এ প্রশ্ন অবান্তর।

আসলে ধর্ম কোনও একশিলা ব্যবস্থা নয়। ধর্মের প্রয়োগ ধর্মকে কখনও দমনের হাতিয়ার, কখনও অধিকারের হাতিয়ার করে তোলে। আর ধর্মাচরণ সব সময় ব্যক্তিগত না-ও হতে পারে। ধর্মীয় অধিকারের লড়াই সমষ্টির হওয়াই স্বাভাবিক। শুধু অধিকারের লড়াই-ই নয়, ক্ষমতার সোপানতন্ত্রে যে ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠের, তার তরবারির ঝনঝনানির বিরুদ্ধে যখন অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক মানুষের ধর্মকে টিকে থাকার লড়াই করতে হয়, তখন তা দলবদ্ধ হবেই। না হলে বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, তেমনই বড় ধর্ম ‘ছোট’ ধর্মকে গিলে ফেলবে। এ ভাবেই ভাদু, টুসুর গান, লোকায়ত ধর্মও হারিয়ে যাচ্ছে, এবং মানুষগুলোও।

এই সংকট থেকে উদ্ধার পেতে হলে সবাইকে পাশাপাশি থাকা অভ্যাস করতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতির মানুষজনকে অন্ত্র থেকে সম্মান করা শিখতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম যেমন বলতে পারে না যে, শুধু আমরাই থাকব এ দেশে কিংবা পৃথিবীতে, তেমনই ধার্মিকও বলতে পারেন না, নাস্তিক, তুম হঠো, আর নাস্তিকও বলতে পারে না যে, সমস্ত ধর্ম নিপাত যাক। যদি আমরা, নাস্তিকের দল, ধর্মের এই বিপর্যয়ের দিনে, জয়োল্লাসে মাতি, তা হলে আমরাও কিন্তু সাম্প্রদায়িক। আমাদের সহনশীলতাও কিন্তু প্রশ্নের মুখে পড়ে। স্কুলের দারোয়ানজির ঠাকুরে পা দেওয়া আসলে দারোয়ানজিকেই অপমান করা। আজ আমার সত্যিই সেই ছোটবেলার ভুল শুধরে দারোয়ানজির শিব ঠাকুরকে বিল্বপত্র দিতে ইচ্ছে করে, শুধু দারোয়ানজির হাসি মুখ দেখার জন্যই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন