টিবির সঙ্গে মানুষের যুদ্ধের গল্পটা অনেক পুরনো। এবং সময়ের সঙ্গে তা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। যখন কোনও চিকিৎসাই ছিল না তখন টিবির অপর নাম ছিল মৃত্যু। আসলে চিকিৎসা-না-পাওয়া টিবি রোগীদের মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ। তার মানে, কেবল খাওয়াদাওয়া আর এটা ওটা জুগিয়ে গেলে ১০০ জন রোগীর মধ্যে ৫০ জন ভাল হয়ে যাবেন নিজে থেকেই। আর যদি আমরা ঠিক চিকিৎসা করতে পারি, তবে এই ভাল হয়ে যাওয়া রোগীর আনুপাতিক হার হবে ৯৮ শতাংশের কাছাকাছি। তাই টিবির চিকিৎসা আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা ধারণা তৈরি হল যে চিকিৎসা করলে টিবি সেরে যায়।
এ পর্যন্ত গল্পটা ভালই। এর পরই জটিলতার শুরু। যদি টিবির চিকিৎসা কোনও কারণে অপর্যাপ্ত হয় তবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে ৩৩ শতাংশের মতো রোগীরা ভাল হবেন, ৩৩ শতাংশ রোগী ভাল না হয়ে ভুগতে থাকবেন ও টিবির সংক্রমণ ছড়াতে থাকবেন, বাকিদের মৃত্যু হবে। সত্যি কথা বলতে গেলে, আজকের জটিলতার জন্য দায়ী হল ‘অপর্যাপ্ত চিকিৎসা’। তাই পর্যাপ্ত অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও টিবির বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ চলতে থাকাটাই আমাদের লজ্জা ও পরাজয়ের প্রতীক।
টিবির জীবাণুরা সহজে মরে না। স্পিরিট, এমনকী অ্যাসিডও এদের অনেক সময় মারতে পারে না। এরা বাতাসে বাহিত হয়ে মূলত নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের দেহে ঢোকে ও ফুসফুস হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শতকরা ১০০ জন জীবাণু আক্রান্ত মানুষের মধ্যে সংক্রমণের এক বছরের মধ্যে ৫ জনের এবং জীবনের অন্য যে কোনও সময়ে আরও ৫ জনের অসুখ হয়।
শরীরের ভেতরে এই জীবাণুরা অনেকেই কখনও ঘুমিয়ে থাকে বা চুপচাপ পড়ে থাকে, কেবল মাঝে মাঝে উঠে সংখ্যা বৃদ্ধি করে আর গণ্ডগোল পাকায়। এই গণ্ডগোল পাকানোর ক্ষমতাটা আবার নির্ভর করে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে জীবাণুরা বংশবৃদ্ধি করে অসুখের সৃষ্টি করে। অপুষ্টি যেমন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমার একটা কারণ, তেমনই মাদকাসক্ত হওয়া, ধূমপান করা, ডায়াবিটিস ও শরীরের নানা অসুখ, ক্যানসারের চিকিৎসায় বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ দিন স্টেরয়েড খাওয়া প্রভৃতির জন্যও প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে পারে। প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে কি নেই, তা মাপার একটা সহজ পদ্ধতি হল মান্টু টেস্ট। মান্টু পজিটিভ হওয়া মানেই কিন্তু অসুখ নয়। এর অর্থ শরীরে জীবাণু ও তার প্রতিরোধ ক্ষমতার উপস্থিতি।
টিবির চিকিৎসাও অন্য সংক্রামক অসুখের চিকিৎসার তুলনায় জটিল। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে টিবি নির্মূল করার জন্য দরকার দীর্ঘ সময় ধরে ওষুধ খাওয়া। আগে যেটা বছর পেরিয়ে যেত সেটাকে প্রথমে ন’মাস ও পরে ছ’মাস ওষুধ খাওয়ানোর গল্পে নামানো সম্ভব হয়েছে। আর এই লম্বা চিকিৎসায় দরকার একাধিক ওষুধের। টিবির চিকিৎসার এই জটিলতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনেক না পাওয়া প্রশ্নের উত্তর।
মজা হল, ক’দিন ওষুধ খেলেই শরীরটা ভাল লাগে, রোগীদের মনে হয় ‘সেরে গেছি’, আর ‘ওষুধের কী দরকার’। অন্য দিকে ঠিক চিকিৎসা না হলেও প্রাথমিক ভাবে একাধিক ওষুধের কোনও একটিতে সাড়া দিলেও কিছু দিনের জন্য রোগ প্রশমিত হয়। আর এই দুই পরিস্থিতিতেই টিবির জীবাণুরা তাদের মৃত্যুবাণকে চিনে নিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে ফেলে। ফলে সেরে যাওয়ার বদলে রোগী একটু ভাল হয়ে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন, বার বার তা ঘটে প্রতিরোধ-অক্ষম জীবাণুর খেলায়। এরা আবার সুস্থ মানুষকে সংক্রামিত করলে সুস্থ মানুষের কেউ কেউ প্রথম থেকেই টিবি রোগী হয়ে পড়েন।
টিবির জীবাণুর ওষুধ প্রতিরোধ-অক্ষম হওয়ার গল্পটার জন্য তাই দায়ী জীবাণু নয়, মানুষ। আমরা যেমন বাঁচতে চাই, জীবাণুরাও চায়। আমরা কর্তব্যে অবহেলা করে জীবাণুদের বাঁচার সুযোগ করে দিই। তাদের ওষুধ-প্রতিরোধক্ষম তৈরি করি। আর শেষে নিজেদের হাত কামড়াই। হ্যাঁ, মানুষের দোষেই আজ টিবির বাড়বাড়ন্ত। বিজ্ঞানী ও বহু চিকিৎসকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের সুফল ছারখার করে দিয়েছে ‘মানুষের দোষ’।
টিবির সার্বিক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা ও প্রকল্প রচনায় ভারতবর্ষ অগ্রগণ্য। এবং অগ্রগণ্য, সম্ভবত, অসাফল্যেও। বিষয়টিকে আজকের আলোচনার পরিধির বাইরে রাখলেও কিছু কথা স্বভাবতই মনে পড়ে। কারণ, ওষুধ-প্রতিরোধী টিবি, বহু-ওষুধ-প্রতিরোধী টিবি, কিংবা সম্পূর্ণ ওষুধ-প্রতিরোধী টিবি আজ বাস্তবতা। বাস্তব এই যে গত প্রায় তিরিশ বছরে বলার মতো তেমন কোনও ওষুধও আবিষ্কার হয়নি, আর যে সব ওষুধ পাওয়া যায় তাদের অনেকেই কিছুটা বা কোথাও অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়েছে।
চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পালমোকেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ