চর্চা: খড়্গপুরের এক প্রশিক্ষণ শিবির। নিজস্ব চিত্র
রেলশহর খড়গপুর থেকে ক্রিকেটের অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় দলে সুযোগ পেলেন খরিদার ছেলে করণ লাল। এর আগে ঝাড়খণ্ডের রাঁচির বাসিন্দা মহেন্দ্র সিংহ ধোনি খড়গপুরে রেলে চাকরি করার সময় ২০০৪ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। অনেকে বলেন, ধোনি তো ঝাড়খণ্ডের ছেলে। খড়্গপুরের ভূমিপুত্র করণের রেল শহরেই বড় হয়ে ওঠা, ক্রিকেটে হাতেখড়ি, রাজ্য থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া। ঘরের ছেলের সাফল্যে রেল শহরের সকলে খুবই খুশি। কেউ কেউ ভাবছেন, হয়তো রেলশহর থেকে জাতীয় দলে যাওয়ার রাস্তা খুলে দিলেন করণ।
খড়্গপুর আগে ফুটবল চর্চার কেন্দ্র ছিল। শহরের বেশ কয়েকজন নিয়মিত কলকাতা ময়দানে প্রথম ডিভিশনের ক্লাবে ফুটবল খেলতেন। খড়্গপুর সেরসা স্টেডিয়ামে রেলের জাতীয় ফুটবল দল, ভারতের ফুটবল দল বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলে গিয়েছে। ১৯৭৫ সালে খড়্গপুরের কয়েকজন ফুটবলার মিলে তৈরি করেছিলেন খড়্গপুর ব্লুজ ক্লাব। রেলের সাইকেল স্ট্যান্ডে ক্লাবের কাজকর্ম শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে ফুটবলের পাশাপাশি শনি ও রবিবার ক্রিকেট খেলা শুরু করেন ফুটবলাররা। ক্রিকেটে খরচ বেশি। পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য স্থানীয় দোকানদারদের কাছে সাহায্য চান ক্লাবের সদস্যরা। কলকাতার শিল্পীদের দিয়ে জলসা করে টাকা জোগাড় করতেন ক্লাবের ছেলেরা।
ধীরে ধীরে খড়্গপুরে ক্রিকেট খেলার পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। ১৯৯০ সালের পর থেকে সেরসা স্টেডিয়াম ও বাইটন মাঠে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। কয়েক বছর পর বাইটন মাঠে শুরু হয় সাউথ স্টার ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প ও ব্লুজ ক্রিকেট কোচিং সেন্টার। ২০০১ সালের পর খড়্গপুরে চাকরি করতে আসেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। সেই সময় মাহি রেলের হয়ে সেরসা-সহ শহরের বিভিন্ন মাঠে টানা ক্রিকেট খেলেছেন। ২০০৪ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পরেই শহরের বেশ কিছু অভিভাবক সন্তানদের ক্রিকেট শেখানোর জন্য ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে ভর্তি করছেন।
২০১১ সালে খরিদার ছেলে করণ লাল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ব্লুজ ক্রিকেট ক্যাম্পে ভর্তি হন। প্রশিক্ষক সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দেবরাজ মুখোপাধ্যায় ও সুমন নাগের প্রচেষ্টায় ব্লুজের ছেলেরা উন্নতি করে চলেছেন। করণ বছর দুয়েকের মধ্যে মহকুমা ও জেলা স্তরে ভাল খেলে অনূর্ধ্ব ১৬ বাংলা দলে সুযোগ পান। সেখান থেকে অনূর্ধ্ব ১৯ এবং অনূর্ধ্ব ২৩ দলেও জায়গা পেয়েছেন। কোচবিহার ট্রফিতে আটটি ম্যাচে ৫০১ রান এবং ৩২টি উইকেট পাওয়ায় বিসিসিআই নজরে আসেন এই অলরাউন্ডার। বিসিসিআই থেকে করণকে জাতীয় অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। আগামী ২ মার্চ কেরলে দলের সঙ্গে যোগ দেবেন করণ। দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান ও ইন্ডিয়া-এ এবং ইন্ডিয়া বি দলের সিরিজ খেলা হবে। ইন্ডিয়া-বি দলে খেলবেন করণ। জাতীয় দলে করণ সুযোগ পাওয়ায় রেল শহরের ক্রিকেট মহলে খুশির হাওয়া। প্রশিক্ষক সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘করণের মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। সহ-প্রশিক্ষক দেবরাজ মুখোপাধ্যায় ও সুমন নাগ হাতে ধরে ছোটদের ক্রিকেট শেখায়। করণকে ওরাই ক্রিকেট ব্যাকরণ শিখিয়েছে। রাজ্য দলে সুযোগ পেয়ে নিজেকে মেলে ধরে ধাপে ধাপে এগিয়েছে করণ। জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে আমাদের গর্বিত করেছে।’’
শহরের ক্রিকেট পরিকাঠামো কেমন? এই মুহূর্তে খড়্গপুরের সেরসা স্টেডিয়াম, বাইটন মাঠ, খড়্গপুর কলেজ মাঠ, নিমপুরা, মথুরাঘাটি, আইআইটি ক্যাম্পাস, বিএনআর মাঠ-সহ শহরের ন’টি জায়গায় ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প চলছে। প্রায় ৭৫০ জন ছেলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। প্রতি বছরই কলকাতার প্রথম ডিভিশনের বিভিন্ন ক্লাবে ক্রিকেট খেলছে অনেকে। বিভিন্ন বয়সের বাংলা দলেও খড়্গপুরের ছেলেরা নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছে। স্কুল বেঙ্গল দলে সুযোগ পেয়েছে ছেলেরা। সাউথ স্টার ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পের প্রশিক্ষক পার্থ দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘রেল শহরে ক্রিকেট প্রশিক্ষণের পরিকাঠামো ও পরিবেশ এখন অনেক এগিয়ে। বর্তমান ডিআরএম ক্রিকেট খেলায় আগ্রহী। তাই রেলের এলাকায় যে সব ক্যাম্প চলছে সেখানে খেলার পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য রেলের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। করণ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ায় খড়্গপুরের ছেলেদের কাছে অনেক রাস্তা খুলে গেল। করণের ক্রিকেটে ফোকাস আছে। এগিয়ে যাওয়ার সব গুণ রয়েছে। আশা করি, ওকে দেখে রেলশহর অনুপ্রাণিত হবে।’’
রেলের খড়্গপুর ডিভিশনের সেরসা স্টেডিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক রাজেশ সিংহ বলেন, ‘‘খড়গপুরে সেরসা স্টেডিয়ামে করণ ক্রিকেট খেলেছে। সেরসা ও বাইটন মাঠে অনেক ছেলে ক্রিকেট খেলছে। ভবিষ্যতে সেরসা স্টেডিয়ামে সিএবি ও বিসিসিআই-র বিভিন্ন পর্যায়ের খেলা হবে। রেল শহরের ছেলেরা অনেক কিছু শিখতে পারবে। খড়্গপুরের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।’’ ব্লুজ ক্লাবের পুরনো সদস্য সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, করণের এই সাফল্যে তাঁরা খুশি। তিনি বলেন, ‘‘১৯৭৫ সালে আমরা ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলাম। আজ করণ জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’’ সোমনাথবাবুর কথায়, ‘‘করণের মধ্যে প্রতিভা আছে। এখন ইন্ডিয়া টিমে খেলার জন্য সারা দেশের হাজার হাজার ছেলে চেষ্টা করছে। সেখানে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া মুখের কথা নয়। করণের খবর পেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সেই পুরনো দিনের কথা আলোচনা করছিলাম। করণের মতো অনেকে রাজ্য দলে খেলছে। আশা করি, অনেকে রেলশহর থেকে জাতীয় দলে যাওয়ার সুযোগ পাবে।’’
ক্রিকেটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন এমন ব্যক্তিরাও করণের সাফল্যে আশাবাদী। যেমন খড়্গপুরের পুরপ্রধান প্রদীপ সরকার। তিনি বললেন, ‘‘করণ খড়গপুরের নাম জাতীয় পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছে। পুরসভার পক্ষ থেকে করণকে ধন্যবাদ জানাই। পুরসভা ওর পাশে আছে।’’ খড়গপুর শহরের প্রবীণ ক্রিকেটার সুখেশ দত্ত বলেন, ‘‘খড়গপুরের মাটি থেকে জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়ার কঠিন লড়াই করে করণ আমাদের সম্মানিত করেছে। আমরা আশা করব ও একদিন জাতীয় দলে খেলবে। ওকে দেখে বাকি ছেলেরাও এগিয়ে যাবে।’’