Covaxin

রাজনীতির হাতে

ভারতে প্রতিষেধক সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে ফেলা হইল সমর্থন ও বিরোধিতার পরিচিত ছকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২১ ০২:০৭
Share:

এমন হইবে, কে ভাবিয়াছিল? করোনার টিকা পড়িয়া আছে, গ্রহীতা নাই। ভারতে টিকাকরণ সূচনার দিনটি হইতে আজ পর্যন্ত, একটি দিনও লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হয় নাই। বহু টিকা নষ্ট হইয়াছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এই সংশয় দেখিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং টিকা লইয়াছেন। বলিয়াছেন, প্রতিষেধক দুইটি বিজ্ঞানীদের ছাড়পত্র পাইয়াছে, তাই ‘‘অযথা’’ ভয়ের কারণ নাই। অপর দিকে, দিল্লির দুইটি বৃহৎ হাসপাতালের চিকিৎসকরা ‘কোভ্যাক্সিন’ টিকা প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। বেশ কিছু বিজ্ঞানী সাংবাদিকদের জানাইয়াছেন, কোভ্যাক্সিনের পরীক্ষা সমাপ্ত হয় নাই, তাহার কার্যকারিতা প্রমাণিত নহে। সকল তথ্য সর্বসমক্ষে প্রকাশিত না হইলে কোভ্যাক্সিন গ্রহণ করা সমীচীন নহে। আক্ষেপ, এই বিতর্ক কেবল বিজ্ঞানের পরিসীমায় থামিয়া থাকে নাই। দিল্লি-সহ কিছু রাজ্য দাবি করিয়াছে, পরিকল্পিত ভাবে বিরোধী রাজ্যগুলিতেই অপরীক্ষিত কোভ্যাক্সিন পাঠানো হইতেছে। তাহার উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী হর্ষ বর্ধন বলিয়াছেন, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করিতে বিরোধীরা দেশের মানুষকে ভুল বুঝাইতেছেন। প্রতিষেধক প্রস্তুতকারক দুইটি সংস্থার প্রধান পরস্পরের টিকাকে দুষিয়াছেন সাংবাদিকদের সম্মুখে। কোভ্যাক্সিন যে হেতু ভারতে নির্মিত, তাই দেশপ্রেমের আবেগ জাগাইবার চেষ্টাও করিয়াছে নির্মাতা সংস্থাটি। অর্থাৎ টিকার গ্রহণযোগ্যতা, যাহা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষিত ও নির্ণীত হইবার কথা, তাহাকে গণবিতর্কের পরিসরে আনা হইয়াছে। কাহার কথার জোর অধিক, তাহার প্রতিযোগিতা চলিতেছে — যেন নির্বাচনী যুদ্ধেরই একটি প্রসারিত বাহু।

Advertisement

বিষবৃক্ষ শিকড় মেলিলে তাহার ফল ফলিবে সর্বত্র। গত কয়েক বৎসরে ভারতে দলীয় রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এক সর্বগ্রাসী রূপ লইয়াছে। আদালত হইতে গবেষণাগার, হাসপাতাল হইতে বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র স্বাতন্ত্র্য ক্ষয় হইয়াছে। আপন মর্যাদা, বৈশিষ্ট্য ও নিরপেক্ষতা অটুট রাখিতে পারে নাই প্রায় কোনও প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞানও তাহার ব্যতিক্রম নহে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার নিয়মগুলি বিতর্কের উর্ধ্বে, এমন দাবি করিলে ভুল হইবে। কিন্তু তাহার মীমাংসা হয় বিজ্ঞানের নিজস্ব, নৈর্ব্যক্তিক নিয়মে। ব্যক্তির কথার ওজন দিয়া নির্ণয় হয় না। পূর্বনির্ধারিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা করিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিজ্ঞান। প্রতিষেধকের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা করিবার প্রক্রিয়া বহু বৎসরে, বহু পরীক্ষায় নির্ধারিত হইয়াছে, কোনও গবেষক বা গবেষণা সংস্থা তাহা অতিক্রম করিতে পারে না। প্রতিষেধকের কার্যকারিতা অথবা নিরাপত্তা লইয়া কেহ প্রশ্ন তুলিলে তাহার স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন উত্তর দিতে হইবে নির্মাতাকে। সেই বিচারে আবেগ, অভিমান, অথবা অপরের ছিদ্রান্বেষণের স্থান নাই।

ভারতে প্রতিষেধক সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে ফেলা হইল সমর্থন ও বিরোধিতার পরিচিত ছকে। অতিমারি এড়াইতে টিকা প্রয়োজন, তাহা লইতে সকল নাগরিককে উৎসাহিত করা প্রয়োজন, সন্দেহ নাই। পরীক্ষাধীন প্রতিষেধককে ‘আপৎকালীন’ ছাড়পত্র দিবার কেন্দ্রের সিদ্ধান্তও বহু বিজ্ঞানী সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু যাঁহারা নানাবিধ প্রশ্ন তুলিয়াছেন, তাঁহারা উত্তর পাইলেন না কেন? কোভ্যাক্সিন বিতরণ রাজ্যের ইচ্ছাধীন — এই ঘোষণা করিয়া কেন্দ্র কেন পাশ কাটাইল? পরীক্ষাধীন টিকা দিতে হইলে গ্রহীতার সুরক্ষায় বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন। কোভ্যাক্সিন গ্রহীতাদের জন্য সেইগুলি কি গ্রহণ করা হইয়াছে? টিকা লইবার পরে যে সকল মৃত্যু ঘটিয়াছে, সেগুলির কারণ কি যথাযথ নির্ণয় হইতেছে? স্বচ্ছতাই আস্থার ভিত্তি। বিজ্ঞান আপন সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে স্বচ্ছ, সেই কারণেই তাহা নির্ভরযোগ্য। রাজনীতি তাহার স্বভাবসিদ্ধ অস্বচ্ছতা দিয়া বিজ্ঞানকে কলুষিত করিল, জনস্বার্থকেও ব্যাহত করিল। জনগণের বিপুল অর্থে ক্রয় করা টিকার প্রতি আজ বহু মানুষ বিমুখ, ইহার দায় রাজনীতির।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন