স্টেডিয়ামে ঢোকাই যথেষ্ট নয়

সংবাদপত্রে এই মহিলাদের ‘স্বাধীনতার নারী’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। শুধু ইরানি মেয়েরা নন, সারা বিশ্বই এই ঘটনা নিয়ে আপ্লুত। তবে উল্টো প্রশ্নও আছে। ইরানে সত্যিই নারীমুক্তি ঘটল?

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৩
Share:

স্টেডিয়ামে ইরানি মহিলারা।

তেহরানে ২০২২’এর বিশ্বকাপের জন্য কোয়ালিফাইং ম্যাচ খেলল ইরান, কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে। চার হাজারের উপর মহিলা খেলা দেখতে এসেছিলেন সে দিন। তাঁদের মাথা ঢাকা, গায়ে জড়ানো সাদা সবুজ লাল রঙে রঞ্জিত ইরানের পতাকা। প্রতি গোলে তাঁরা প্রবল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন। ক্যামেরা সে ছবি ধরে রেখেছে। চল্লিশ বছর পরে এমন দৃশ্য। কারণ, আয়াতুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ‘ইসলামিক রেভলিউশন’এর পর ১৯৮১ সাল থেকে ইরানি মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে ফুটবল কেন, কোনও খেলাই স্টেডিয়ামে ঢুকে দেখতে পারেননি। ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চেষ্টা করেছিলেন মেয়েদের খেলা দেখতে দেওয়ার। সফল হননি।

Advertisement

সংবাদপত্রে এই মহিলাদের ‘স্বাধীনতার নারী’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। শুধু ইরানি মেয়েরা নন, সারা বিশ্বই এই ঘটনা নিয়ে আপ্লুত। তবে উল্টো প্রশ্নও আছে। ইরানে সত্যিই নারীমুক্তি ঘটল? ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ বলছে, এ হল “জনপ্রিয়তা লাভের এক ঘৃণ্য কৌশল।’’

‘আজাদি’ স্টেডিয়ামে আটাত্তর হাজার আসন আছে। ইন্টারনেটে টিকিট ছাড়ামাত্র মেয়েরাই ব্লক করে ফেলেছিলেন তার নব্বই শতাংশ। কিন্তু সাড়ে তিন হাজারের বেশি মহিলাকে টিকিট দেওয়া হয়নি (পরে আর কয়েকশো জন ঢুকতে পেরেছেন)। ১৫০ মহিলা নিরাপত্তা কর্মী নিযুক্ত হয়েছিলেন। মহিলা চিত্রসাংবাদিকদের কিন্তু ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পুরুষ দর্শক ছিলেন মাত্র হাজার পাঁচেক। বাকি আসন খালি রাখা হল, কিন্তু মেয়েদের দেওয়া হয়নি। উপস্থিত পুরুষদের চেয়ে দু’শো মিটার দূরে মেয়েদের বসতে হয়েছে আলাদা ভাবে।

Advertisement

ইরানি মেয়েদের জীবনে পরতে পরতে পরাধীনতা। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত চলা ‘পহলভি’ যুগে তাঁরা বেশ কিছুটা মুক্তির স্বাদ পাচ্ছিলেন। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায়, খেলাধুলায় মেয়েরা দারুণ সফল হচ্ছিলেন। ‘ইসলামিক রেভলিউশন’-এর পর সেই সুদিন গিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম ২০১৭’-এর ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট’ বলছে, লিঙ্গবৈষম্যের দিক থেকে ইরানের স্থান বিশ্বে একশো চল্লিশতম। মেয়েদের আইনগত অধিকারের নিরিখেও সে দেশের স্থান একেবারে নীচের দিকে। ইরানি মেয়েদের মাত্র উনিশ শতাংশ রোজগার করেন।

বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, বিবাহিত ইরানি মহিলাদের তেইশটি নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হয়। ইরান তাঁদের স্ত্রী এবং মা হিসেবেই দেখতে চায়। বাড়ির বাইরে বা ভিতরে তাঁদের স্বাতন্ত্র্যকে সংবিধান ভাল ভাল কথার আড়ালে ঢেকে ফেলে, সমাজও সেই স্বাতন্ত্র্য বরদাস্ত করে না। নিজের ইচ্ছায় পাসপোর্টের আবেদন করা, বেড়াতে যাওয়া, চাকরি করা, সমহারে বেতন ইত্যাদি প্রায় কোনও অধিকার মেয়েদের নেই। আইন যা-ই বলুক, নারীর উপর নির্যাতন চালিয়েও অপরাধী প্রায়শই শাস্তি পায় না। নির্যাতিতা আইনের আশ্রয় নিতেই ভয় পান। তার কারণ আছে। ধরা যাক, কোনও নারী ধর্ষণের অভিযোগ এনেও প্রমাণ করতে পারলেন না। তখন তাঁকেই সহ্য করতে হবে বেত্রাঘাত। আর ধর্ষণের সাক্ষী জোগাড় করাও সহজ নয়। চার জন মুসলমান পুরুষ, তিন জন পুরুষ ও দু’জন নারী, দু’জন পুরুষ ও চার জন নারী— এই কম্বিনেশনের যে কোনও একটির সাক্ষ্য পেলে তবে অপরাধ প্রমাণ করা যাবে। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার শহরে বত্রিশ শতাংশ এবং গ্রামে তেষট্টি শতাংশ ইরানি মহিলা। বিবাহবিচ্ছেদে তাঁদের অধিকার আছে কিন্তু সে পদ্ধতি এমন জটিল, যে বিচ্ছেদ পাওয়া খুবই মুশকিল। এমনকি খেলাধুলায় পর্যন্ত তাঁরা অংশ গ্রহণ করতে পারেন না, স্বামীর অনুমতি না থাকলে।

আমাদের দেশের মেয়েরা যে ইরানি মেয়েদের চেয়ে অনেক ভাল আছেন, এমন দাবি হয়তো করা যায় না। কিন্তু এ দেশে মিডিয়া, জনমত ইচ্ছে করলে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সরব হতে পারে। বছরে দশ লক্ষ কন্যাভ্রূণ হত্যার রেকর্ড নিয়েও আমাদের দেশের মেয়েরা মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে ট্রাক্টর চালানো, সর্বত্র কৃতিত্বের ছাপ রাখেন। ইরানে সংবাদমাধ্যম, সমাজ সংস্কার, ব্লগিং— কোনও কর্মক্ষেত্রেই মেয়েরা স্বাগত নন, নিরাপদও নন। নারীমুক্তি আন্দোলনের কর্মীদের বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে হয় কারাগারে। নাসরিন সতৌদেন নামের এক মহিলা আইনজীবী মেয়েদের তথা মানুষের অধিকারের দাবিতে সরব হয়েছেন বলে বার বার তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, দেওয়া হয়েছে চাবুকের নিদান। তাঁর ইতিমধ্যেই ভোগ করা ও প্রস্তাবিত ‘শাস্তি’র মোট পরিমাণ তেত্রিশ বছর জেল এবং একশো আটচল্লিশ ঘা চাবুক।

কাজেই এক দিন শর্তসাপেক্ষে টিকিট কেটে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে ফুটবল খেলা দেখে কয়েক হাজার ইরানি মেয়ে নারীমুক্তির পথে অনেক পা হেঁটে ফেললেন, বললে মিথ্যে বলা হবে। আবার, চার দশকের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে পরিস্থিতির চাপে হলেও যে অন্য পুরুষের উপস্থিতিতে মেয়েদের স্টেডিয়ামে ঢুকতে দিতে ইরান বাধ্য হল, সে ঘটনার গুরুত্বও অস্বীকার করা চলে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন