প্রচারের ঢক্কানিনাদ দিয়ে কি সত্যকে স্তব্ধ করা সম্ভব

রাজা তোর কাপড় কোথায়

দুর্গাপুর থেকে বিনীতা রহমান এক চিঠিতে লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদী সরকার সম্পর্কে আজকাল যা লিখছেন তার সঙ্গে একমত। কিন্তু আপনার দীর্ঘ দিনের পাঠিকা হিসেবে একটা প্রশ্ন।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৩৩
Share:

ব্যর্থ: বিজেপির ‘কার্যকর্তা মহাকুম্ভ’ সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মাল্যদান করা হচ্ছে, ভোপাল, ২৫ সেপ্টেম্বর। পিটিআই

দুর্গাপুর থেকে বিনীতা রহমান এক চিঠিতে লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদী সরকার সম্পর্কে আজকাল যা লিখছেন তার সঙ্গে একমত। কিন্তু আপনার দীর্ঘ দিনের পাঠিকা হিসেবে একটা প্রশ্ন। ২০১৪ সালে তো লিখেছিলেন স্বপ্নের এক সওদাগর আসছেন। তখন আপনার রচনায় এই তীব্র সমালোচনার পরশ তো পেতাম না। সেই বাজপেয়ী-আডবাণী যুগ থেকে আপনার লেখা পড়ে মনে হয়েছিল যেন বিজেপির বিষয়ে কিঞ্চিৎ নরমই। এমনকি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ বহু ঘটনা আপনার লেখায় পড়েছি। কিছু মনে করবেন না। আপনার বর্তমান অবস্থানকে সমর্থন জানালেও এই পরিবর্তনের কারণ জানাবেন?

Advertisement

এই পত্রাঘাতে আমি যুগপৎ খুশি এবং উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন, কারণ বাঙালি পাঠক পাঠিকার মতো লেজ়ার রশ্মি দিয়ে খবরের কাগজ পড়া কিন্তু এই রাজধানী শহরে কম দেখি। অতএব মনে রাখতেই হবে যা লিখছি যা বলছি, আপ সিসিটিভি কে নিগরানি মে হ্যায়। তবে খুশি, দীর্ঘ দিনের পাঠিকা এই প্রশ্নটি করেছেন বলে। কারণ এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ারও প্রয়োজন আছে।

শুনুন বিনীতা দেবী, একটা গল্প শুনুন। সুকুমার রায়ের ‘ব্যাঙের রাজা’। রাজবাড়িতে যাওয়ার যে পথ সেই পথের ধারে দেওয়ালের পাশেই ব্যাঙেদের পুকুর। এক দিন সর্দার ব্যাঙ ফুর্তির চোটে লাফ দিয়ে, পড়বি তো পড়, একেবারে দেওয়াল টপকে রাজপথের মধ্যিখানে। সিপাই সান্ত্রি লোকলস্কর দলবল নিয়ে রাজা তখন সভায় চলেছেন। মাথায় মুকুট। রঙিন পোশাক। আলো ঝলমল। চতুর্দোলায় চড়ে রাজা সভায় যাচ্ছেন। লোকেরা ‘রাজা-রাজা’ বলে নমস্কার করছে। সর্দার ব্যাঙের মনে হল, কী সুন্দর। আহা। আমাদের যদি একটা রাজা থাকত। ফিরে এসে সর্দার ব্যাঙেদের সভা ডেকে বলল, আমাদেরও রাজা চাই। ব্যাঙ দেবতা আকাশের মেঘের কাছে সমবেত আর্জি জানানো হল। তখন দেবতা মরা গাছের ডাল ভেঙে তাদের সামনে ফেলে দিয়ে বললেন, এই তোমাদের রাজা। পুকুর পাড়ে সেই ভাঙা ডালের ওপর মস্ত মস্ত ব্যাঙের ছাতা জোছনায় চকচক করতে লাগল। তাই দেখে ব্যাঙের ফুর্তি তো আর ধরে না। কিন্তু এক দিন সর্দার ব্যাঙের গিন্নি বললেন, ছাই রাজা। এ রাজা তো নড়েও না। চড়েও না। আবার ব্যাঙ দেবতার কাছে সমবেত আর্জি, নতুন রাজা দাও। তখন মেঘ দেবতা একটা সাদা সুন্দর বককে পুকুরের ধারে নামিয়ে বললেন, এই নে, তোদের নতুন রাজা।

Advertisement

চকচকে ঝকঝকে ধবধবে রাজা। ভাল রাজা। সুন্দর রাজা। কিন্তু পর দিন ঘুম ভেঙে বক দেখল এ তো দারুণ পুকুর। এখানে অনেক ব্যাঙ। সে তখন এ দিক ও দিক তাকায়, আর টুপ টুপ করে ব্যাঙ খায়। সবাই এল সর্দারের কাছে। বিহিত চাই। সর্দার গিন্নি গেল বক রাজার কাছে। শামুক আছে, শামুক খা না, রাজা হয়ে আমাদের খেতে চাস। বকটা তখন সর্দার গিন্নিকেও খেয়ে ফেলল। কান্নার রোল ব্যাঙ সমাজে। এ বার দেবতার কাছে গিয়ে সর্দার ব্যাঙ বলল, পাজি রাজা। লক্ষ্মীছাড়া রাজা। দুষ্টু রাজা। চাই না। রাজাটাজা আর কখনও চাইব না।

বিনীতা দেবী, অভি়জ্ঞতার মধ্য দিয়েই আমরা শিক্ষালাভ করি। ইতিহাসের পটে দেখি আমাদের সাম্প্রতিককে। রাজনেতা ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়নও বদলায়। রাজনেতারাও বদলান।

২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের সময়ের পটভূমিটা মনে করুন। দশ বছরের মনমোহন শাসনে তখন তিতিবিরক্ত মানুষ। অপ্রতিরোধ্য নরেন্দ্র মোদীর অভ্যুত্থান। দিল্লি এসেছি ১৯৮৭-তে। তখন থেকে বিজেপি ‘কভার’ করি। নরেন্দ্র মোদী অশোক রোডে দলের সদর কার্যালয়ের পিছনে ছোট একটা ঘরে থাকতেন। প্রথমে রাজ্য স্তরে মুখ্যমন্ত্রী, পরে বিজেপির মতো এক বৃহৎ সর্বভারতীয় দলের প্রধান কান্ডারি হয়ে উঠেছেন। গুজরাতে যখন মোদী মুখ্যমন্ত্রী, তখন ভাইব্রান্ট গুজরাত নামক শিল্প সম্মেলন দেখতে ফি বছর যেতাম। মুগ্ধ হয়েছি। কেশুভাই পটেলের রাজত্বের জমিদারি স্টাইল বদলে মোদী গুজরাতে সংস্কারের হাওয়া এনেছিলেন। ২০১৪ সালে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভেবেছিলাম, বিজেপিকে তিনি যখন ২৮২টি আসনের দলে পৌঁছে দিয়েছেন, তখন হয়তো এ বার তাঁর অগ্রাধিকার হবে উন্নয়ন। সাম্প্রদায়িকতার যে তকমা তাঁর জামায় লাগানো হয়েছে, তিনি নিজেই চাইবেন ভাবমূর্তি বদলে উন্নয়নের পথে হাঁটতে।

সাড়ে চার বছর অতিবাহিত। নির্বাচন আবার দরজায় কড়া নাড়ছে। আবার হিসেবের খাতা নিয়ে বসেছি। গোটা দেশ জুড়ে অর্থনীতির কান্না। বিদেশি বিনিয়োগ বাজারে আসা তো দূরের কথা, ভারতীয় বাজার থেকে কোটি কোটি টাকার লগ্নি প্রত্যাহৃত হচ্ছে। পেট্রলের দাম ডিজ়েলের দাম বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে। আর ডিজ়েলের দাম বাড়া মানে তরিতরকারি থেকে সমস্ত ভোগ্যপণ্যেরও দাম বাড়া। কৃষিক্ষেত্রে চাষিদের ওপরও তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। নোট বাতিল, জিএসটি— প্রতিটি উদ্যোগে দেশের ধনী-দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সব গোষ্ঠীই তিতিবিরক্ত। চাকরিবাকরি নেই। বেকার যুবকদের হাহাকার, আবার অন্য দিকে কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে বই কমছে না।

সাংবাদিক আমরা। রাজনেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক হয়। সে সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রেখেও প্রশাসন ও দলের শোচনীয় ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনায় মুখর হতেই হবে। প্রজার স্বার্থে কাজ করা যেমন রাজধর্ম, সাংবাদিকের ধর্ম তেমন জো-হুজুর বৃত্তি নয়, সত্য উপলব্ধিকে ব্যক্ত করা।

দিল্লিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সাংবাদিক বৈঠক। টিভির পর্দায় লাইভ টেলিকাস্ট। সুন্দর সাবলীল ইংরেজি অথবা অনর্গল হিন্দিতে মুখপাত্ররা প্রধানমন্ত্রীর নানা জয়গাথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। তখন সেই ব্যাঙের সর্দারের মতোই মনে হয়, আহা কী সুন্দর। কিন্তু যখনই এ দেশের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে যাই সেখানে গিয়ে দেখি পরিস্থিতি যথা পূর্বম্। দেশের কোনও উন্নতি হয়নি তা কখনওই বলব না। নিশ্চয়ই হয়েছে। তবে যা হয়েছে তাতে এ দেশের কোনও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। যে অচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখেছিলাম সে স্বপ্নভঙ্গই হল বাস্তব সত্য। সংবাদমাধ্যমকে নানা ভাবে নিয়ন্ত্রণের কৌশলে যতটা সময় বিজেপির শীর্ষনেতারা দিয়েছেন ততটা সময় মানব কল্যাণে দেননি। প্রচারের ঢক্কানিনাদে কি সত্যকে চিরকালের জন্য স্তব্ধ করা সম্ভব?

আর উন্নয়নের বদলে ভোট জেতার কৌশল হিসেবে দেখছি দেশ জুড়ে মেরুকরণের রাজনীতি। ইলাহাবাদ শহরের নামবদল থেকে শবরীমালার মন্দিরের কুসংস্কারকে জিইয়ে তাকে দক্ষিণের অযোধ্যা ইসু বানানো, রাম মন্দির নির্মাণের প্রশ্নে গত পাঁচ বছর কিছু করতে না পারলেও এখন আইন করে মন্দির নির্মাণের দাবি তোলা। ভোটের ফল যা-ই হোক, যা দেখছি তাতে জো-হুজুর হয়ে মুখে কুলুপ আঁটতে পারছি না। তুলতেই হবে সেই পরিচিত প্রশ্নটি: রাজা, তোর কাপড় কোথায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন