যো গীও যাহা ত্যাগ করিতে পারে না, ভারত তাহা হইতে সহজে মুক্তি পাইবে কি? উত্তরপ্রদেশের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মন্ত্রীদের গাড়ির উপর লালবাতির ব্যবহার বহাল রাখিয়াছেন। বিষয়টি আলোচিত হইয়াছে, কারণ পঞ্জাবে ক্ষমতায় ফিরিয়া কংগ্রেসের অমরিন্দর সিংহ লালবাতি ত্যাগ করিয়াছেন, মন্ত্রীদের জন্যও তাহা নিষিদ্ধ করিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে লালবাতি বর্জন করিয়াছেন বহু পূর্বে, তাঁহাকে অনুসরণ করিয়াছেন বেশ কিছু মন্ত্রী। দিল্লিতে আপ সরকারের মন্ত্রীরাও বাতিহীন গাড়ি ব্যবহার করেন। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যে মন্ত্রী, বড়-ছোট আমলা, সাংসদ, বিধায়ক, এমনকী পঞ্চায়েত প্রধানরাও লালবাতি লইয়া ঘুরিতেছেন। লালবাতি ভারতের ‘ভিআইপি’ সংস্কৃতির প্রতীক, যাহা সাধারণ নাগরিক হইতে ভিন্ন এক স্বতন্ত্র শ্রেণি নির্মাণ করিয়াছে। লালবাতির প্রকৃত প্রয়োজন জরুরি কাজের জন্য দ্রুত গতিতে যাইবার সংকেত, তাহা লোকে ভুলিয়াছে। কিছু পদাধিকারীকে ‘জরুরি’ বলিয়া চিহ্নিত করা এখন লালবাতির প্রধান কাজ হইয়াছে। ইহাদের সকল কাজই ‘জরুরি’, বাজার করিতেও লালবাতি হাঁকাইতে হয়। সুপ্রিম কোর্ট বহু পূর্বেই এই ভিআইপি সংস্কৃতিকে ‘প্রজাতন্ত্রের বিরোধী’ ও ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা’ আখ্যা দিয়াছিল। যোগী আদিত্যনাথের তাহাতে কিছু যায় আসে না।
সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক পদাধিকারীদের জন্য লালবাতি, এবং জরুরি পরিষেবা ও পুলিশের জন্য নীল বাতির ব্যবহারও নির্দিষ্ট করিয়াছিল। বাতির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করিতে রাজ্যগুলিকে নূতন তালিকা প্রস্তুত করিতে বলিয়াছিল। কার্যক্ষেত্রে রাজ্যগুলি অকাতরে নীল, হলুদ কিংবা সাদা বাতি বিলাইয়াছে। তাহার কোনওটি দপদপ করে, কোনওটি ঘুরপাক খায়, কোনওটি তীব্র শব্দ করে। পুলিশ যদি বা বাতির ভ্রান্ত ব্যবহার টের পায়, তাহা প্রতিরোধ করিবার সাহস তাহার হয় না। তাই যথেচ্ছ অপব্যবহার সত্ত্বেও কোনও নেতা-আমলার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হয় নাই। পঞ্জাবেরই কিছু বিধায়ক জানাইয়া দিয়াছেন, মুখ্যমন্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও তাঁহারা লালবাতি ব্যবহার করিবেন। ভোটে জিতিয়া সেই অধিকার মিলিয়াছে, বলিয়াছেন এক বিধায়ক।
ইহাই ভিআইপি সংস্কৃতির মূল লক্ষণ। রাষ্ট্রক্ষমতা যাঁহারা হাতে পাইয়াছেন, তাঁহারা সেই ক্ষমতা নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করিতে লজ্জিত নহেন। আইনের শাসন, নিয়মের আনুগত্য হইতে তাঁহাদের মুক্তি মিলিয়াছে, ইহাই তাঁহাদের বিশ্বাস। তাই শিবসেনার সাংসদ বিমানকর্মীকে জুতাপেটা করিয়াও অলজ্জিত থাকেন। যাঁহারা লালবাতি ত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহারাই বা এই ভিআইপি সংস্কৃতি ত্যাগ করিয়াছেন কি? পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকাইলে অন্তত আশ্বাস মিলিবে না। টোল ট্যাক্স চাহিলে, ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জরিমানা করিলে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা পুলিশের সহিত দুর্ব্যবহার করেন। নাগরিক জীবনের নানা পরিসরে নেতা ও তাঁহাদের অনুচরেরা যথেচ্ছ নিয়ম ভাঙেন। দেশবাসীকে তাঁহারা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করিয়া রাখিয়াছেন। লালবাতি ত্যাগ করিয়াও এই ভয়ানক ভিআইপি সংস্কৃতি ধরিয়া রাখিলে তাহা প্রতারণার নামান্তর।