গোড়াপত্তন: ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের উদ্বোধনে সেজে উঠেছে বর্ধমান স্টেশন। ‘দি ইলাসট্রেটেড লন্ডন নিউজ়’-এ ১৪ এপ্রিল ১৮৫৫-য় প্রকাশিত ছবি
সাইমন কমিশন নিয়ে বিক্ষোভ তখন তুঙ্গে। ১৯২৮ সাল। কমিশনের বিরুদ্ধে লাহৌরে প্রতিবাদ-মিছিলে পুলিশের লাঠির ঘায়ে আহত হয়ে প্রাণ দিলেন পঞ্জাবের সব থেকে জনপ্রিয় নেতা লালা লাজপত রাই। বিপ্লবী ভগৎ সিংহ আর তাঁর সহযোগীরা শপথ নিলেন, প্রতিশোধ নিতে হবে। কিন্তু পুলিশ সুপার জেমস স্কটকে মারতে গিয়ে ভুল করে ভগৎ সিংহ আর রাজগুরুর গুলি প্রাণ নিল সহকারী সুপার জন সন্ডার্সের। ভগৎ সিংহরা কিন্তু তখন ধরা পড়েননি।
বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ থানার ওঁয়াড়ি গ্রামের ছেলে বটুকেশ্বর দত্ত ১৯২৪ থেকেই ভগৎ সিংহের দলে। শিখলেন বোমা বানানো। সন্ডার্স হত্যার পর বটুকেশ্বরও আত্মগোপন করলেন নিজের গ্রামে। পুলিশি হানার আগেই গ্রাম ছাড়লেন। ৮ এপ্রিল ১৯২৯— দিল্লিতে কেন্দ্রীয় আইনসভায় পাবলিক সেফটি বিল আর ট্রেড ডিসপিউট বিল নিয়ে আলোচনার সময় ভগৎ সিংহ আর বটুকেশ্বর দত্ত দর্শক গ্যালারি থেকে বোমা ছুড়লেন। কেউ মারা যাননি, তবে আহত হন ক’জন। দুই বিপ্লবী ধরা পড়লেন। এ বার ফাঁস হল সন্ডার্স হত্যার কথা, বিচারের প্রহসন শেষে ফাঁসি হল ভগৎ সিংহ, সুখদেব আর রাজগুরুর। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বটুকেশ্বরকে পাঠানো হল আন্দামানে। সেখানে অকথ্য অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে আট বছর পর ফিরিয়ে এনে পটনায় গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৪১-এ মুক্তি পেয়ে ফের ’৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। আবার কারাবাস। মুক্তি পান স্বাধীনতার পর। পটনাতেই থেকে যান বটুকেশ্বর, প্রয়াত হন ১৯৬৫ সালে।
এ হেন বটুকেশ্বর দত্ত নিশ্চয়ই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের অন্যতম নায়ক। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তথা বিহার রাজ্য বিজেপির সভাপতি নিত্যানন্দ রাই গত ২০ জুলাই বটুকেশ্বরের প্রয়াণ দিবসে পটনায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে বলেছেন, বর্ধমান রেল স্টেশনের নাম বটুকেশ্বরের নামে পরিবর্তন করা হবে। অথচ সত্যি বলতে, সশস্ত্র বিপ্লববাদের অন্যতম আঁতুড়ঘর বাংলার মাটিতে এমন বিপ্লবীর সংখ্যা অগণিত। মাস্টারদা সূর্য সেন কি বাঘা যতীনের সহযোদ্ধারা কি ভগৎ সিংহের সহযোগীর মতো মর্যাদাবান নন? আর দিল্লিতে বোমা? ১৯১২ সালে খোদ দিল্লির রাস্তায় বড়লাট হার্ডিঞ্জের উপর বোমা ফেলেছিলেন নদিয়ার যে কিশোর বসন্তকুমার বিশ্বাস, যাঁর ফাঁসি হয়েছিল এই অপরাধে, তাঁর কথা ভুলি কী করে? মনে রাখতে হবে, বসন্তের মন্ত্রগুরু রাসবিহারী বসুর জন্ম কিন্তু বর্ধমান জেলার রায়না থানার সুবলদহ গ্রামে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রাসবিহারী বসুর ভূমিকা বোধ হয় ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের কৃতিত্বের তর-তম নির্ধারণ অবান্তর। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য, দেশমানুষের উন্নতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন এমন মানুষ তো বর্ধমানের মাটিতে কম জন্মাননি। ক’জন আর স্বীকৃতি পেয়েছেন। রাসবিহারী বসু তো সুপরিচিত, কিন্তু রাসবিহারী ঘোষকে ক’জন মনে রেখেছি? খণ্ডঘোষ থানারই তোড়কোনায় তাঁর জন্ম। বিখ্যাত এই আইনজীবী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বর্ধমানে প্রথম আন্দোলন গড়ে তোলেন। কংগ্রেস সভাপতি হন। কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মোট দানের পরিমাণ প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা! আবার ‘ডন সোসাইটি’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কালনার অকালপৌষ গ্রামের অরবিন্দপ্রকাশ ঘোষ, যিনি হিন্দু স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদে যোগ দেন। তাঁকে ‘ছোট অরবিন্দ’ বলা হত। জেলায় স্বদেশি আন্দোলন সংগঠনে, দুর্ভিক্ষের সময় সেবায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। চান্না গ্রামের যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি পরে নিরালম্ব স্বামী নামে পরিচিত হন, ছিলেন ভারতে বিপ্লববাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বরোদায় শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। ১৯০২ সালে বাংলায় ফিরে নানা জায়গায় তিনি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ‘যুগান্তর দল’-এর তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, যোগ ছিল ‘অনুশীলন দল’-এর সঙ্গেও। আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত হয়েও ছাড়া পান যতীন্দ্রনাথ। স্বাধীনতা সংগ্রামের আর এক একনিষ্ঠ কর্মী সদর থানার সাটিনন্দী গ্রামের যাদবেন্দ্রনাথ পাঁজা মহাত্মা গাঁধীর ডাকে ২৪ পরগনার মহিষবাথানে লবণ সত্যাগ্রহে অংশ নেন। সে সময় বর্ধমানে কংগ্রেস বলতে যাদববাবুকেই বোঝাত, তাঁকে বলা হত ‘বর্ধমানের গাঁধী’। ১৯২০-তে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার সময় তিনি জুতো পরা ছেড়ে দেন, স্বাধীনতার পর মন্ত্রী হয়েও নগ্ন পদেই চলাফেরা করতেন! কই, জেলার কোনও রেল স্টেশনের জন্য এঁদের নামের কথা তো ওঠে না।
আর দেশসেবা ছেড়ে যদি সাহিত্যসেবার কথা ধরি তা হলে দেখব বাংলার মধ্যযুগের সাহিত্যকারদের অধিকাংশই বর্ধমানের সন্তান। রামাই পণ্ডিত (শূন্যপুরাণ), মালাধর বসু (শ্রীকৃষ্ণবিজয়), কাশীরাম দাস (মহাভারত), চৈতন্যজীবনীকার কৃষ্ণদাস কবিরাজ, লোচনদাস, জয়ানন্দ, গোবিন্দদাস কর্মকার ও বৃন্দাবনদাস, বৈষ্ণব পদকর্তা নরহরি সরকার, বাসু ঘোষ, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস প্রমুখ, সাধক কমলাকান্ত— এমন সব নামের মধ্যে এক জনকে কি বাছা যায়?
গুরুত্বের দাবিদার যেখানে অনেকেই, সেখানে এমন নির্বাচন অসম্ভব শুধু নয়, অযৌক্তিকও। নামকরণের ১৬৪ বছর পেরিয়ে আজ হঠাৎ বর্ধমান স্টেশনের নাম বদলের কী জরুরি প্রয়োজন দেখা দিল? মুঘলসরাইয়ের মতো স্টেশনের নাম বদল যে রাজনৈতিক প্ররোচনায় হয়, বর্ধমানের ক্ষেত্রেও কেউ যদি তেমন সিঁদুরে মেঘ দেখেন তা হলে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় কি? জেলার মাটিতে বটুকেশ্বর দত্তের কোনও কর্মকাণ্ড না থাকলেও তাঁর গ্রামে তিনি কিন্তু বিস্মৃত নন। সেখানে তাঁর নামে পাঠাগার আছে, তাঁর উত্তরসূরিরা যখন গ্রামের বাড়ি বিক্রি করতে সচেষ্ট হন তখন জেলা পরিষদ তাঁদের বুঝিয়ে সেটি দানপত্র করিয়ে নেয়, বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে বাড়ির সংস্কার ও সংরক্ষণও হয়েছে। অর্থাৎ জন্মস্থানে বটুকেশ্বরের স্মৃতিরক্ষা হয়নি এমন তো নয়।
সব থেকে বড় কথা, কোন নামটি পরিবর্তন করতে চাইছি? রেল স্টেশনের ক্ষেত্রে কোনও স্থাননামই পরিবর্তন করে ব্যক্তিনাম দেওয়া ঠিক নয়। অধিকাংশ স্থাননামই পুরনো, তার সঙ্গে অজস্র ইতিবৃত্ত-কাহিনি-স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। সুদূর এবং সাম্প্রতিক অতীতে মানুষ যখন প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক নানা কারণে আদি নিবাস ছেড়ে অন্যত্র বসতি করেছে, প্রায় সব সময়েই সঙ্গে নিয়ে এসেছে সেই নাম, বসতি পত্তন করেছে পুরনো নামে। কাজেই এই নাম বদল মানে শিকড় ছিঁড়ে ফেলা, জোর করে কৌম স্মৃতির অবলুপ্তি। অবশ্য দেশের ইতিহাস ইচ্ছেমতো তৈরি করতে যারা দ্বিধাহীন, তাদের কাছে এই যুক্তি নিছক অরণ্যে রোদন।
বর্ধমান কি যে কোনও স্থাননাম? খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে চব্বিশতম জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীর রাঢ়দেশের বজ্রভূমি ও সুহ্মভূমিতে এসেছিলেন। সেখানে তাঁর ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা সুখকর না হলেও জৈন ‘আচারাঙ্গ সূত্র’-এর এই উল্লেখ ‘রাঢ়’ নামাঙ্কিত ভূখণ্ডে জনবসতির প্রাচীনত্বের প্রথম পুঁথিগত প্রমাণ। মহাবীরের ‘বর্ধমান’ নামের সঙ্গে অঞ্চল ‘বর্ধমান’-এর নামকরণের সম্পর্ক ছিল কি না বলা কঠিন, যদিও বর্ধমান জেলায় জৈন পুরাকীর্তির নিদর্শন কম নয়। গুপ্ত যুগে বাংলার দু’টি প্রধান প্রশাসনিক বিভাগ ‘পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি’ ও ‘বর্ধমান ভুক্তি’র অস্তিত্বের পাথুরে প্রমাণ যথাক্রমে কুমারগুপ্তের দামোদরপুর তাম্রশাসন (খ্রিষ্টীয় ৫ম শতক) ও গোপচন্দ্রের মল্লসারুল তাম্রশাসন (খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতক)। দ্বাদশ শতকে লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর লিপি ও বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতেও এই ‘বর্ধমান ভুক্তি’র উল্লেখ আছে। ভুক্তিকে আজকের ‘প্রদেশ’ বলা যায়। বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’ কি স্কন্দপুরাণে বর্ধমান জনপদের উল্লেখ নিয়ে যদি সংশয়ও থাকে, তাম্রশাসনের প্রমাণে বর্ধমান নামটা তো অন্তত দেড় হাজার বছরের পুরনো। ষোড়শ শতকে আকবরের ভূমি জরিপে বাংলা সুবা উনিশটি ‘সরকার’-এ বিভক্ত হয়েছিল, আইন-ই-আকবরি অনুযায়ী সরকার সরিফাবাদের মধ্যে ছিল ‘মহাল’ বর্ধমান। মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলা সুবাকে ১৩টি ‘চাকলা’য় ভাগ করেন, যা প্রায় আজকের জেলার সমার্থক। বর্ধমান ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম চাকলা। তার পর বর্ধমান জমিদারি তো স্বাধীনতা পর্যন্ত বহাল ছিল। অর্থাৎ নামটির ধারাবাহিকতাও সংশয়াতীত। বাংলায় আর ক’টা স্থাননাম এই প্রাচীনত্ব ও পরম্পরার গৌরব দাবি করতে পারে?
ভারতীয় রেলের ইতিহাসেও বর্ধমান স্টেশনের গুরুত্ব যথেষ্ট। ভারতে প্রথম যাত্রিবাহী ট্রেন চলে ১৬ এপ্রিল ১৮৫৩, বম্বে থেকে ঠাণে। আর পূর্ব ভারতে ১৫ অগস্ট ১৮৫৪ হাওড়া থেকে হুগলি প্রথম ট্রেন চলে। ৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৫ রানিগঞ্জ অবধি ট্রেন চালু হয়, আর সেই দিনই বর্ধমান শহরে এই রেলপথের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এমন নাম কি হাতে ক্ষমতা থাকলেই পাল্টে দেওয়া যায়?