গৌরবের বহুবচন

রাজনীতির এই রূপ আকাঙ্ক্ষার কারণ হইতে পারে স্বপ্না-হিমার জয়ের ধরনটি। নোবেলজয়ী ব্যক্তি দেশের গর্ব হইলেও কোন কৃতিত্বে সেই গর্ব, ইহা অনুধাবন করা জনসাধারণের পক্ষে কষ্টকর। অপর পক্ষে, ক্রীড়ায় পদক জয়ের অঙ্কটি সর্বজনবোধ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:৪৯
Share:

স্বপ্না বর্মন ও হিমা দাস।

পদক জয়ের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত স্বপ্না বর্মন, হিমা দাসেরা একাকী ছিলেন। প্রস্তুতির কালে স্বপ্নার মা বাসনাদেবীকে কোচ বলিয়াছিলেন, ভাল ফল পাইতে হইলে কন্যার প্রয়োজন ডিম, কলা এবং মাংসের স্টু। সাধ্য ছিল না। অতএব জুটিয়াছিল মোটা চালের ভাত, ডাল, শাক। জাকার্তায় যখন ট্র্যাকে নামিয়াছিলেন হিমা, তখন বিদ্যুৎ ছিল না তাঁহাদের কান্ধুলিমারি গ্রামে। অতএব, হিমার পরিবার তাঁহার সোনার দৌড় প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ পান নাই। তবে এই দুই কন্যা যখন তারকা হইয়া দেশে ফিরিলেন, তাঁহাদের ঘিরিয়া ধরিল হাজার ফ্ল্যাশবাল্‌বের ঝলকানি। দার্জিলিংয়ের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া পাঁচটি শাড়ি ও এক ঝুড়ি ফল লইয়া বাসনাদেবীর নিকট পৌঁছাইয়া গেলেন। ভিডিয়ো কলে স্বপ্নাকে জানাইলেন, সাংসদ মারফত কৃতীকে অভিনন্দন জানাইতেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। হিমার মূর্তি স্থাপনের প্রস্তাব করিলেন অসমের মন্ত্রী বসন্ত দাস। অর্থাৎ পদক জয়ের পরমুহূর্তেই রাজনীতির কারবারিরা গৌরবকে বহুবচনে ভাগ করিয়া লইতে উদগ্রীব।

Advertisement

রাজনীতির এই রূপ আকাঙ্ক্ষার কারণ হইতে পারে স্বপ্না-হিমার জয়ের ধরনটি। নোবেলজয়ী ব্যক্তি দেশের গর্ব হইলেও কোন কৃতিত্বে সেই গর্ব, ইহা অনুধাবন করা জনসাধারণের পক্ষে কষ্টকর। অপর পক্ষে, ক্রীড়ায় পদক জয়ের অঙ্কটি সর্বজনবোধ্য। সহস্রের সম্মুখে লক্ষ্যপূরণ করিতে নামেন খেলোয়াড়। সফল হইলে পদক মিলে। ভারতীয় কন্যাদের আপন বলে বলীয়ান হইয়া পদক জয়ের আখ্যান একটি নিখাদ কাহিনি— সেই জয়ের পিছনে পরিশ্রম আছে, দক্ষতা আছে; কোনও বাবা-কাকার জোর বা কাহারও হাতযশ নাই। সম্ভবত শুধু ক্রীড়াতেই এমন নির্ভেজাল জয় সম্ভব। আন্ডারডগের জয় মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, ফলে হরেক বাধা অতিক্রম করিয়া স্বপ্না-হিমা-দীপাদের পদক জয়ের আখ্যানগুলি মানুষের হৃদয়ের অতি কাছাকাছি। সেই কারণেই রাজনীতিকরা সেই জয়টিকে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত জয়ের গণ্ডি হইতে তুলিয়া রাষ্ট্রের বিজয়গাথা করিয়া তুলিতে চাহেন। কেননা, যাহা রাষ্ট্রীয়, তাহাতেই রাজনৈতিক নেতাদের বিলক্ষণ অধিকার। অতএব, স্বপ্না-হিমাদের জয়কে রাষ্ট্রীয় অর্জন হিসাবে দেখাইতে রাজনীতিকদের এই অত্যুৎসাহ।

স্বপ্না-হিমাদের লড়াইটি ব্যক্তিগত। পরিবেশগত প্রতিকূলতার সহিত তাঁহাদের অতিক্রম করিতে হইয়াছে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা। দীর্ঘ পথ সাইকেলে সওয়ার হইয়া অনুশীলনে পৌঁছাইতে হইত স্বপ্নাকে। প্রতিটি অঞ্চলে ক্রীড়াকেন্দ্র না থাকিলেও চলে, কিন্তু দূরবর্তী কেন্দ্রে পৌঁছাইবার মতো গণপরিবহণ না থাকা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। আন্তর্জাতিক স্তরের যোগ্য পরিকাঠামো না থাকার দায়ও রাষ্ট্রেরই। ভারতে ক্রিকেট ব্যতীত অপর ক্রীড়ায় তত বাণিজ্য নাই। যে খেলার বাজার নাই, তাহার রাষ্ট্র থাকিবে, ইহাই কাম্য। স্বপ্না-হিমাদের জন্য তাহা হয় নাই। প্রস্তুতির সময় যোদ্ধাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে নাই রাষ্ট্র। অথচ জয়ের পরে যোদ্ধাদের কৃতিত্বকে ব্যবহার করিবার ক্ষেত্রে তাঁহাদের পূর্ণ উদ্যম লক্ষণীয়। ইহাই প্রকল্প— ক্রীড়াকে ব্যবহার করিয়া সরকারি প্রচার এবং জাতীয়তাবাদের ঢক্কানিনাদ। উহা কেবল তাহাদের বিজ্ঞাপনের বাহন। অগ্রগতির সহায়। আজ যাহা স্প্রিন্ট কিংবা হেপ্টাথলন, কাল তাহা অপর কিছু। রাজনীতির নিকট সকলই নিমিত্ত মাত্র।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন