ফাইল চিত্র।
এত নিম্নগামী কেন রাজনীতির সব কিছু? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে দ্রুত অবক্ষয়, রাজনৈতিক সৌজন্যের ক্রমাবলুপ্তি, রাজনৈতিক ভাষ্যের প্রবল অধঃপতনের সাক্ষী অনেক দিন ধরেই হতে হচ্ছে, সে কথা ঠিক। কিন্তু অবনতি দেখছি বলে অবনতিকেই ভবিতব্য এবং অমোঘ ধরে নেব কেন? অবনমনের প্রবণতায় রাশ টানার আপ্রাণ চেষ্টাই তো বাঞ্ছনীয়। রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব রয়েছে যে স্তরে, সেই স্তরে সঙ্কট থাকতে পারে। নেতৃত্বের দায়িত্ব হল সেই সঙ্কটের নিরসন ঘটানো। কিন্তু সাম্প্রতিকতম রাজনৈতিক টানাপড়েনটা দেখিয়ে দিল, শীর্ষ রাজনীতিকরা নিজেরাই ওই সঙ্কটটার শিকার। অতএব, দৃষ্টিকটূ কাদা ছোড়াছুড়ির ঢঙে অরাজনৈতিক ভাষায় পরস্পরকে আক্রমণ করলেন মুকুল রায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
বড় নেতা দলত্যাগ করছেন বা দল বদলাচ্ছেন, এ দৃশ্যকে অনৈতিক মনে হতে পারে। কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে এ দৃশ্য বিরল নয় মোটেই। রাজনীতিতে এই ধরনের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ভারতবাসী অভ্যস্ত। অতএব, মুকুল রায় তৃণমূলের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করে বা সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়ে নিদারুণ অস্বাভাবিক কিছু ঘটাননি। তাই এই দলত্যাগের জেরে অস্বাভাবিক ভাষায় রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে যাবে, তেমনটাও প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু এই দলত্যাগকে কেন্দ্র করে যে সব শব্দ পরস্পরের প্রতি প্রয়োগ করল দুই শিবির, তাতে আর যা-ই প্রমাণিত হোক, রাজনৈতিক সুরুচির উপস্থিতি প্রমাণিত হয় না।
বাচ্চা ছেলে, বুড়ো ভাম, গদ্দার, কাঁচরা বাবু, কাঁচা ছেলে, চাকর— কখনও প্রকট, কখনও প্রচ্ছন্ন ভাবে এমনই নানা ‘বিশেষণ’ পরস্পরের দিকে ছুড়লেন মুকুল রায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এই সব শব্দ কি আদৌ রাজনৈতিক আক্রমণের অভিধানে ঠাঁই পেতে পারে? শীর্ষস্তরের দুই রাজনৈতিক নেতার মুখে এই সব শব্দ কি আদৌ মানানসই? সপ্তাহখানেক আগে পর্যন্তও একই রাজনৈতিক দলে ছিলেন মুকুল রায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘ দিন এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে তাঁরা রাজনৈতিক সংগ্রাম করেছেন। বিচ্ছেদ হওয়া মাত্রই তাঁরা পরস্পরের প্রতি এই স্তরের ভাষা প্রয়োগ করবেন?
আরও পড়ুন: কাঁচরাপাড়ার কাঁচরা বাবু গিয়েছেন, দল বেঁচেছে: পাল্টা পার্থর
সৈফুদ্দিন চৌধুরী, সমীর পূততুণ্ডদের সিপিএম-ত্যাগের সাক্ষী হয়েছিল এক সময় এ বাংলা। রাজনৈতিক আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ তখনও দেখা গিয়েছিল বিস্তর। কিন্তু সে রাজনৈতিক ভাষ্য ছিল আদ্যন্তই আদর্শকেন্দ্রিক। আদর্শে কে খাঁটি, কে ভেজাল, বিতর্কটা ছিল তা নিয়েই। জাতীয় রাজনীতির এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে কী ভাবে সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছিল, এ বাংলা তাও দেখেছে। অপরিসীম তিক্ততার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল সংশয় নেই। তবু রাজনৈতিক লড়াইটা ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে নেমে আসেনি সে সময়েও। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের যাত্রাপথ ধরে আরও একটু পিছিয়ে গেলে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কংগ্রেস-ত্যাগের পর্বও স্মৃতিতে উঁকি দেয়। রাজীব গাঁধীর সঙ্গে প্রবল সঙ্ঘাতের জেরে কংগ্রেস ভেঙে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস গড়েছিলেন প্রণব। তখনও এত রুচিহীন পারস্পরিক আক্রমণের সাক্ষী হতে হয়েছিল বলে মনে পড়ে না।
দলত্যাগজনিত কারণে বড় নেতাদের মধ্যে বৈরিতা অনেক ছোট বিষয়। আদর্শগত ফারাকের কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর বিভিন্ন দলে অবস্থান করেন যে বড় নেতারা, তাঁদের মধ্যে বৈরিতার অবকাশ অনেক বেশি বরং। জাতীয়তাবাদী নেতা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক বিরোধ সুবিদিত। কিন্তু সেই বিরোধেরও একটা রাজনৈতিক উচ্চতা ছিল, মর্যাদার বোধ ছিল। আজকের রাজনীতিতে সেই উচ্চতা এবং মর্যাদার বোধটাই সবচেয়ে অমিল।
রাজনৈতিক উচ্চতার সংজ্ঞাটাই আজ বদলে গিয়েছে সম্ভবত। আদর্শগত দার্ঢ্য নয়, নির্বাচনী সাফল্যই রাজনৈতিক উচ্চতার মাপকাঠি অধিকাংশের কাছে এখন। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও অনেক সঙ্কীর্ণ অতএব। এ ভাবেই গা ভাসিয়ে চলি যদি, অদূর ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ভাষ্যের আরও অবনমনে আশ্চর্য হওয়ার অধিকার থাকবে না আমাদের।