ধর্ম বা রাজনীতি

এপ্রিলের শেষে অমিত শাহ বঙ্গে আসিবেন। রামলালা এপ্রিলের গোড়াতেই আসিয়া পড়িলেন। রামনবমী উপলক্ষে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত যে সশস্ত্র শোভাযাত্রার সাক্ষী থাকিল, তাহাকে নিছক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ভাবিবার বিন্দুমাত্র কারণ নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

এপ্রিলের শেষে অমিত শাহ বঙ্গে আসিবেন। রামলালা এপ্রিলের গোড়াতেই আসিয়া পড়িলেন। রামনবমী উপলক্ষে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত যে সশস্ত্র শোভাযাত্রার সাক্ষী থাকিল, তাহাকে নিছক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ভাবিবার বিন্দুমাত্র কারণ নাই। বিজেপি নেতারা তাহা ভাবাইতে আগ্রহীও নহেন। রাজ্যে তাঁহাদের শক্তিবৃদ্ধি হইতেছে, এই মিছিলগুলি তাহারই প্রদর্শনী। উন্মুক্ত তরবারি হস্তে অবশ্য রাজনৈতিক মিছিল হয় না— ভারতীয় রাজনীতির ঘোলা জলে অস্ত্র অপরিহার্য হইলেও সভ্য সমাজ সেই অস্ত্রের আস্ফালনকে স্বীকৃতি দেয় না। রাজনীতির গায়ে ধর্মের নামাবলি জড়াইয়া দিলে স্বীকৃতি আদায় সহজতর হয়। এক্ষণে প্রশ্ন, অস্ত্র হাতে শোভাযাত্রা রামনবমী উদ্‌যাপন কবে প্রথা হইয়া উঠিল? পশ্চিমবঙ্গে এই প্রশ্নের উত্তরসন্ধান অবান্তর, কারণ এই রাজ্যে রামনবমী উদ্‌যাপনের ঐতিহ্যই অতি ক্ষীণ। উৎসবটি মূলত যে অঞ্চলের, সেখানেও এই অনুষ্ঠানটি সীমাবদ্ধ ছিল পূজা, রামায়ণ পাঠ এবং ভজন-কীর্তনে। অস্ত্র আস্ফালনের সংস্কৃতিটি অর্বাচীন। তাহার সহিত হিংস্রতার প্রতীকী যোগ এতই প্রকট যে নাগরিক সমাজের ঘোর আপত্তি স্বাভাবিক। সেই আপত্তিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া প্রশাসনের দায়িত্ব। ধর্মের মোড়কে রাজনীতির অস্ত্রপ্রদর্শনীকে কোনও যুক্তিতেই সমর্থন করা যায় না, তাহা বলিয়া দেওয়া বিধেয়। রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ সহ একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রশাসন অস্ত্র আইনে অভিযোগ করিয়াছে, তাহা এই প্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ।

Advertisement

নাগরিক সমাজের আপত্তিতে দিলীপ ঘোষরা প্রত্যাশিত ‘যুক্তি’ খাড়া করিয়াছেন— মহরমের দিন অস্ত্র হাতে মিছিলে তো এমন আপত্তি দেখা যায় না! এই মন্তব্য বিজেপির রাজনৈতিক অভিজ্ঞান। তবুও প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, মহরমের মিছিল কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাহা রাতারাতি চালু হয় নাই, শোক উদ্‌যাপনের এই প্রথাটিকে রামনবমীর সহিত গুলাইয়া ফেলার কারণ নাই। কিন্তু, কোনও একটি প্রথা বহু দিন ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে, ইহা সেই প্রথাটিকে আরও অনন্ত কাল চালাইবার যুক্তি হইতে পারে না। বিশেষত সেই সময়ে, যখন দিলীপ ঘোষেরা এই উদাহরণটির ঢাল খাড়া করিয়া নিজের অস্ত্রের আস্ফালনের স্বীকৃতি দাবি করিতেছেন। মহরমের মিছিলও অধুনা যে ভঙ্গিতে হয় তাহা চলিতে পারে কি না, প্রশাসনকে ভাবিতে হইবে। বস্তুত, যে অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে অস্ত্রপ্রদর্শনের প্রথা আছে, প্রত্যেকটির রীতি ও পদ্ধতি হয়তো ফের বিবেচনা করা জরুরি। প্রয়োজনে সেই অনুষ্ঠানগুলিরও অনুমতি দেওয়া চলিবে না। কিন্তু, সেই প্রথাগুলি আছে বলিয়া রামনবমীর তরবারি মিছিলও মানিয়া লইতে হইবে, এই যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নহে।

বরং, সন্ধান করা প্রয়োজন, এত অস্ত্র কোথা হইতে আসিল? পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে তরবারি আর ত্রিশূল থাকে, হিন্দু কুলপতিরাও সম্ভবত তেমন দাবি করিবেন না। স্পষ্টতই, রামনবমীর মিছিলে প্রদর্শন করিবার জন্যই অস্ত্রগুলি আনা হইয়াছে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাইয়া দেওয়া হইয়াছে। মিছিলে অস্ত্র প্রদর্শন ‘হিন্দু’দের বলশালী হইয়া উঠিবার প্রতীক হইতে পারে, তরবারিগুলি কিন্তু প্রতীকী নহে। সেগুলি সত্য তরবারি, ২০০২ সালের গুজরাতে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা বাহুবলীদের যে রকম তরবারি হাতে নিউটনের তৃতীয় সূত্র প্রমাণ করিতে দেখা গিয়াছিল। দেখা যাইতেছে, মিছিলের আয়োজকরা রাজ্যের আনাচেকানাচে এই বিপজ্জনক অস্ত্র পৌঁছাইয়া দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। গোটা ‘নেটওয়ার্ক’টি কী ভাবে কাজ করিল, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা প্রশাসনের কাজ। কোনও রাজনৈতিক কারণে নহে, নিছকই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বটি পালন করিতেই এই অনুসন্ধান কর্তব্য।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন