সম্প্রতি হিমাচল প্রদেশে গিয়েছিলাম একটি বেসরকারি হাসপাতালের সংকট নিয়ে আলোচনা করতে। ২০১৪ সাল অবধি হইহই করে চলার পর হঠাৎ হাসপাতালটির রোগীর সংখ্যা কমতে থাকে। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা আলাপ-আলোচনার শেষে সিদ্ধান্ত: কাছাকাছি একটি সরকারি হাসপাতালে সুযোগসুবিধার উন্নতি (আপগ্রেডেশন) হওয়ার ফলেই এই হাসপাতালটির অমন দুরবস্থা।
এই একটিমাত্র উদাহরণই স্বাস্থ্যব্যবস্থার বর্তমান অসংগতিকে সামনে নিয়ে আসে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে দারিদ্র এবং সামাজিক বৈষম্য বিপুল, সেখানে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ কতটা কী করতে পারে, তা গভীর বিতর্কের বিষয়। এক দিক থেকে সরকারি হাসপাতালের অসংখ্য দুর্বলতার জন্য বেসরকারি হাসপাতালের একটা চাহিদা আছেই। মনে রাখতে হবে, ২০০২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যে বেসরকারি উদ্যোগ বেড়েছে অনেকখানি, বেড-শেয়ার–এর অনুপাত ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৩ শতাংশ। চিকিৎসার মান নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা বাড়ছে, সঙ্গতিও বাড়ছে, ইন্টারনেটে তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগের সঙ্গে সঙ্গে সহজ অসুখেও দুর্মূল্য চিকিৎসার প্রচার মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে। মানুষের চাহিদা এবং ক্ষমতার মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। খুব ভাল সরকারি চিকিৎসা হয়তো পারত বেসরকারি ক্ষেত্রের স্বেচ্ছাচারিতাকে আটকাতে। কিন্তু সেটা ঘটেনি। ১৯৮৬ সালে আমাদের সার্জারির মাস্টারমশাই সরকারি হাসপাতালে গিয়ে জটিল অপারেশনগুলো করতেন, এমনকী নিজের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অপারেশনগুলোও। নব্বইয়ের দশকের পর পরিস্থিতিটা পুরো উল্টে গেল। সেটা কিন্তু কেবল ডাক্তারের লোভের জন্য নয়। পরিকাঠামোর নিজস্ব ক্ষয়ও একটা বড় কারণ।
বেসরকারি চিকিৎসা ভারতে এসেছে, সেটা মঙ্গলের কথা। প্রথম দিকে বিভিন্ন নন-প্রফিট ট্রাস্ট কাজটা শুরু করলেও আশির দশকের মধ্যেই দেখা গেল যে পরিকাঠামোর খরচ এতটাই বেশি যে লগ্নিকারীরা এগিয়ে না এলে প্রতিষ্ঠানগুলো চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তখন থেকেই ‘ফর-প্রফিট’ বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রসার। এই প্রসারের প্রয়োজন যে ছিল, সেটা মানতে হবে। তবে এও মানতে হবে যে, এর মধ্যেই প্রচুর গোলমালও রয়েছে। অনেক ধরনের গোলমাল, অনেকগুলো স্তরে। সেগুলোর জন্যই আজকের এই সংকট।
প্রথমত, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রটি যথেষ্ট শ্রমনির্ভর। অনেক সময় লাগে অর্থনৈতিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। প্রথম ২-৩ বছর বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখিও হতে হয়। ফলে একটা হাসপাতাল প্রথম ৩-৪ বছর চালানোটা একটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। ক’টা হাসপাতালই বা সস্তায় বা ফ্রি-তে জমি পায়? যে সব সংস্থা ঋণ দেয়, তারাও বড় অঙ্কের সুদ নেয়। কর তো আছেই। রোগীর দিক থেকে দেখতে গেলে ৫০০০০ টাকা নিশ্চয়ই অনেক, কিন্তু ব্যবসা চালানোর পক্ষে এটা হয়তো খুবই কম।
তাই, হাসপাতাল তৈরির কাজে যাঁরা এগোন, তাঁরা একটু দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এগোন। তার মধ্যেই কেউ কেউ একটা অন্য সুযোগ পেয়ে যান। তাঁদের কাছে চিকিৎসা ক্ষেত্রটি দাঁড়িয়ে যায় ‘প্রফিট’ বাড়ানোর যন্ত্র, সেবার কাজটা গৌণ হয়ে পড়ে। লোভ এসে থাবা বসায়।
দ্বিতীয়ত, এরই মধ্যে ডাক্তারদের উপর রোগীরা বিরাট ভরসা করতে চান, ভাবেন তাঁরা এসে পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু ডাক্তাররা অনেক সময়ই সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হন। এরও একটা প্রেক্ষিত আছে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে আসন পাওয়া একটা টাকার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে যত বেশি দেবে, সে তত উপরে জায়গা পাবে। এইখান থেকেই ডাক্তারদের নৈতিক বোধটা নষ্ট হতে শুরু করে, কত কম সময়ে কত উপার্জন করা যায় সেটাই হয়ে দাঁড়ায় জীবনের মোক্ষ। তার উপর ডাক্তার হলে সামাজিক মর্যাদার তরতর করে বৃদ্ধির আজব ভাবনা তো আছেই। অবশ্যই সকলের কথা বলা হচ্ছে না, কিন্তু অনেকেই রোগীদের সমান মানুষ হিসেবে দেখেন না, অভ্যেসই দাঁড়িয়ে যায় নীচের দিকে তাকিয়ে কথা বলা। অবাক লাগে যখন দেখি ডাক্তাররাও বোঝেন না কেন শাহরুখ খানের সাচ্ছল্যের কথা শুনে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া হয় না, কিন্তু ডাক্তাররা মার্সিডিজ চড়লে হতে পারে! আরে, সিনেমা দেখাটা মানুষের নিজের পছন্দ অপছন্দের বিষয়। আর ডাক্তার দেখানোটা মানুষের বাধ্যতা। অসুস্থ মানুষ ডাক্তারেরই শরণাপন্ন হন, ফিল্মস্টারের নয়।
ঠিকই, বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের উপরও একটা অমানুষিক চাপ থাকে ‘পারফর্ম অর পেরিশ’ মর্মে। কিন্তু তাঁরা কেন নিজেদের এত ক্ষমতাহীন মনে করেন? কেন তাঁরা একত্র হয়ে প্রতিবাদ করেন না, বলেন না যে ‘রোগীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের মধ্যে আর কোনও ভাবনাচিন্তা ঢোকানোর অধিকার কারও নেই, রোগীর কীসে ভাল হবে তা নিয়ে আমার বিবেচনার উপর জোর ফলানোর অধিকার কারও নেই’? এ কাজটা করেন না বলেই ডাক্তারদের এই অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যে তাঁরাও কি হাসপাতালের প্রফিট-সন্ধানে সহযোগী? রোগীকেন্দ্রিক ভাবনাটা না থাকার জন্য যে শূন্যস্থান তৈরি হয়, সেটা পূর্ণ করে দেন লাভ-ভক্ত ব্যবসায়ীরা।
এটাই ধরে নেব যে, সব ডাক্তারই রোগীর ভাল করতে চান। কিন্তু ডাক্তাররা কেন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার-এর ‘ইনসেনটিভ’ দিয়ে নিজেরা চালিত হবেন, সে কথা তাঁদেরই ভাবতে হবে। তাঁদের ক্লিনিক্যাল সিদ্ধান্ত কী ভাবে প্রযুক্তি সরবরাহকারী কোম্পানিদের নির্দেশ দ্বারা চালিত হতে পারে? এই ব্যর্থতাই কি ডাক্তারদের একটি দ্বৈত-সংকটে ফেলে দিচ্ছে না যেখানে তাঁরা রোগীদের আস্থাও হারিয়েছেন, আবার কোনও প্রতিষ্ঠানে কী ভাবে চিকিৎসা চলবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাটাও হারিয়ে ফেলেছেন?
তৃতীয়ত, অসম্ভব ত্রুটিপূর্ণ স্বাস্থ্য বিমা ক্ষেত্রের কথাও বলতে হবে বইকী। রোগী হাসপাতালে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যদি জানতে চাওয়া হয় রোগীর বিমা আছে কি নেই, সেটা কোনও অন্যায় নয়। এই তথ্যটা জরুরি। বিমা যদি থাকে, তা হলে পেপারওয়ার্ক এখান থেকেই শুরু করতে হবে। কিন্তু এও ঠিক যে, এখান থেকেই শুরু হয় নানা অদ্ভুত খোঁজখবর, তদন্ত। হাসপাতালের কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন এই চিকিৎসা না করে ওই চিকিৎসা হচ্ছে ইত্যাদি। হাসপাতালের পক্ষে তখন স্বচ্ছ নৈতিক অবস্থান নেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। বিমার সরবরাহকারীরা বলতে পারেন, হাসপাতালগুলো যা ইচ্ছে তা-ই করে বলেই তাঁরাও এই পদ্ধতি নিতে বাধ্য হন। কিন্তু এটা খানিকটা এক ধরনের সমস্যাকে অন্য ধরনের সমস্যা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।
শল্য চিকিৎসক
(চলবে)