সম্পদ থেকেই সম্পর্কে

‘ওয়েলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার’ নামে রবীন্দ্রনাথ একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। লেখাটি তাঁর ‘সিটি অ্যান্ড ভিলেজ’ নামের আগের বড় একটি লেখারই যেন সংক্ষিপ্ত রূপ।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ০০:১৫
Share:

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত মালিকানা ও সম্পদের অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপসাধন ঘটিয়ে শ্রেণিগত আত্মপরিচয় থেকে নিজেকে ‘মুক্ত’ করার চেষ্টা তিনি করেননি। ফলে অনেক সময়েই আগমার্কা বামপন্থীরা ‘জমিদার’ রবীন্দ্রনাথকে শ্রেণিশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মানবেন্দ্রনাথ রায় রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাসের প্রসঙ্গটি নিয়ে কবির সমালোচনা করেছিলেন।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত মালিকানায় বিশ্বাস করলেও পুঁজির প্রতাপে তাঁর আস্থা ছিল না। তাঁর পিতামহ দ্বারকানাথের পুঁজি ও প্রতিপত্তি সম্পর্কে কবি প্রায় নীরব, দ্বারকানাথের প্রতি কবির অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথের যে আগ্রহ, রবীন্দ্রনাথের তার বিন্দুমাত্রও ছিল না। নেশনের দাপটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে যে মুনাফাসর্বস্ব দানবীয় পুঁজি সভ্যতাকে কম-বেশি গ্রাস করছিল তাকে তিনি ‘সঙ্কট’ বলেই চিহ্নিত করেছিলেন। এই পুঁজির বিরোধিতার জন্য যে ‘বিকল্প’ আদর্শে তিনি বিশ্বাস করতেন তাকে বলা চলে সামাজিকতার আদর্শ। সেই আদর্শ সম্পদের ব্যক্তিগত অধিকারের বিলোপসাধন দাবি করে না, সম্পদশালীর সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা গভীর ভাবে মনে করিয়ে দেয়।

‘ওয়েলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার’ নামে রবীন্দ্রনাথ একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। লেখাটি তাঁর ‘সিটি অ্যান্ড ভিলেজ’ নামের আগের বড় একটি লেখারই যেন সংক্ষিপ্ত রূপ। ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় ১৯৩০ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত লেখাটিতে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট জানান, তিনি মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পদসাধনের বাসনা মানুষের প্রকৃতিগত। ক্ষমতা থাকলে কেউ জোর করে অপরের অতিরিক্ত ও ব্যক্তিগত বিত্ত দখল করে সবাইকে আপাত ভাবে সমান করে দিতে পারে বটে, কিন্তু গায়ের জোরে তো মানুষের মনকে বদলে দেওয়া যায় না। ব্যক্তিগত সম্পদসাধনের মানুষী বাসনা তো যাওয়ার নয়। আর এই ব্যক্তিগত সম্পদ বিষয়টিও তো ‘এক রকম’ নয়। সম্পদ তো আমাদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যম বিশেষ। ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার হরণ করলে তো আমাদের ব্যক্তিত্বকেই খণ্ডিত করা হয়।

Advertisement

ধরা যাক এক জন বই কেনেন, এক জন সংগ্রহ করেন শিল্পকর্ম, কেউ করেন বাগান। সেই সব কাজে ব্যক্তিগত পুঁজি লাগে। এই বই, শিল্পকর্ম, পুষ্পিত বাগানের অধিকার হরণ করে সবাইকে যদি সম্পদবিহীন এক ছাঁচে ঢালা মানুষ করে তোলার চেষ্টা চলে, তা হলে তো কেবল তাঁদের সম্পদই হরণ করা হচ্ছে না, তাঁদের ব্যক্তিত্বের আলাদা আলাদা প্রকাশভঙ্গিকেও ধ্বংস করা হচ্ছে। এই ছাঁচে ঢালা মানুষ রবীন্দ্রনাথের ভয়ের কারণ। এক সময় এই জোর করে ছাঁচে ঢালার ব্যবস্থার প্রতি মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তখন বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সাম্যের ছাঁচ যায় ভেঙে। রাশিয়ার চিঠি গ্রন্থে সাবধান করে দিয়ে লিখেছিলেন তিনি, ‘‘ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না।’’ মানুষের সম্পদসৃষ্টির বাসনাকে তিনি যেমন স্বীকার করে নিচ্ছেন, তেমনই মনে করিয়ে দিচ্ছেন নিজের উদ্বৃত্ত সম্পদ সামাজিক কাজে ব্যবহার করা চাই। পুরনো ভারতে উদ্বৃত্ত ব্যক্তিগত সম্পদকে অপরের হিতসাধনে ব্যবহার করার সামাজিকতা গড়ে উঠেছিল বলেই তিনি মনে করেন। এখানেই ভারতীয় সমাজ তাঁর মতে পুঁজিবাদী নেশনের থেকে আলাদা।

রবীন্দ্রনাথ সম্পদের সামাজিকতার মাধ্যমে সম্পর্কের সামাজিকতার কথা বলছেন। তিনি লক্ষ করেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ক্রমশ কলকাতা যে ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছিল তার মধ্যে বিচ্ছেদ ও বিযুক্তি হয়ে উঠছিল মুখ্য। এই বিচ্ছেদ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ও মানুষের সঙ্গে মানুষের। শহরের মানুষেরা তাঁদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাহিদা পূর্ণ করার জন্য অপরের থেকে নিজেকে আলাদা করছিলেন। একের সঙ্গে অপরের যে স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক, তা বিশ শতকের কলকাতায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথ মনে করছিলেন এই বিচ্ছিন্নতার ব্যাধি তৈরি হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যক্তিগত চাহিদা থেকেই। তাঁর মতে, মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদসাধনের বাসনা হরণ করা যেমন অসম্ভব, মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদাকে প্রকাণ্ড থেকে প্রকাণ্ডতর করে তুলে অন্য মানুষ ও প্রকৃতিকে বৃহতের চাপে মেরে ফেলাও তেমনই অন্যায়। শহর খেয়েদেয়ে মোটা হবে আর ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামের মানুষ রুগ্‌ণ হবেন, এই অসাম্যের তিনি তীব্র বিরোধী। বিশ শতকের কলকাতায় বসে তিনি তাই উনিশ শতকের পুরনো কলকাতার কথা ভাবেন। ‘সমবায়নীতি’ সংক্রান্ত প্রবন্ধেও তিনি লিখেছেন, তখনকার ধনীরা শুধু আত্মসম্ভোগের দূরত্বই তৈরি করেননি, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ‘আত্মত্যাগের দ্বারা যোগ রচনা’ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ছে তাঁদের সে কালের কলকাতার বাড়িতে সহসা এসে চৌকিতে বসে তামাক চাইবার লোকের অভাব ছিল না। ব্যক্তিগত বিত্তের দূরত্ব সে কলকাতায় তৈরি হত না, কারণ ধনীরা সম্পর্কের সামাজিকতা স্বীকার করতেন। উঠতি কলকাতার ব্যবসায়ী বড়লোকেরা রবীন্দ্রনাথের কাছে সম্মান পাননি, পড়তি জমিদাররা পেয়েছেন। এ তাঁর নিজের শ্রেণির প্রতি নিছক মমত্ব নয়। ধনী ব্যক্তি সম্পদের ও সম্পর্কের সামাজিকতা যেখানে স্বীকার করেন সেখানে জোর করে ব্যক্তিগত সম্পদের বিলোপসাধনের প্রয়োজন হয় না বলেই রবীন্দ্রনাথ হিতবাদী বিত্তশালীদের সমর্থন করেন।

এই ‘সম্পদের সামাজিকতা’ ও ‘সম্পর্কের সামাজিকতা’র ধারণা রবীন্দ্রনাথ কোন আদর্শ থেকে গ্রহণ করলেন? গ্রহণ করলেন প্রকৃতির কাছ থেকে। পরিবেশকেন্দ্রিক নীতিবোধ নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন তিনি। প্রকৃতি তার উদ্বৃত্ত সম্পদ মানুষকে সহজে দেয়। জল দেয়, শস্য ও অন্যান্য সম্পদ দেয়, কুক্ষিগত করে রাখে না। প্রকৃতির এই সহজে দেওয়া সম্পদই প্রকৃতির সামাজিকতা। এই সামাজিকতার সুফল শুধু মানুষ একক ভাবে ভোগ করার অধিকারী নয়, না-মানুষেরও সে অধিকার আছে। তাই কবি যখন ‘সিটি অ্যান্ড ভিলেজ’ লিখছিলেন ইংরেজিতে, সমকালে বাংলায় লিখছিলেন ‘রক্তকরবী’— মানুষ যে ভাবে শুধু নিজের লোভের জন্য অসামাজিক উপায়ে প্রকৃতিকে লুট করছে, সে নাটকে তার বিরোধিতা ছিল। প্রকৃতির সামাজিকতার আদর্শকেই যেন কবি সম্পদের সামাজিকতা ও সম্পর্কের সামাজিকতায় রূপান্তরিত করে নিয়েছিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন