Mehbooba Mufti

বন্দুক নয় আলোচনা, শুনতে ভাল, কিন্তু কাশ্মীর শান্ত হবে তো?

দমন রেসিপি-তে গত তিন বছরে কাজ হল কোথায়? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষালদমন রেসিপি-তে গত তিন বছরে কাজ হল কোথায়? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির সঙ্গে রাজনাথ সিংহ।—ফাইল চিত্র।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ কিছু দিন আগে শ্রীনগরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। দেড় ঘণ্টার সেই বৈঠকটিতে কোনও তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন না। মেহবুবা সে দিন রাজনাথকে বলেন, বিজেপি আমাকে সমর্থন করে তার পর এই উপত্যকায় যা করল ও যা করে চলেছে তাতে তো কাশ্মীরের মানুষের কাছে আমার দল পিডিপি-র রাজনৈতিক পরিসরটাই ধূলিসাৎ করে দিচ্ছ। তাতে আমার রাজনৈতিক ক্ষতি যা হওয়ার হবে কিন্তু তোমরা কি কাশ্মীরে সন্ত্রাসকে রুখতে পারবে? মেহবুবার বক্তব্য, এর ফলে কাশ্মীরিরা যদি পিডিপি-কে পরিত্যাগ করে তা হলে কিন্তু এখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি আরও বেড়ে যাবে। মেহবুবার বক্তব্য, ওমর আবদুল্লা ও তাঁর বাবা ফারুক আবদুল্লাও অতীতে ভারতের মুখ হতে গিয়ে হাত পোড়ান। তা হলে কোনও আঞ্চলিক দলই যদি উপত্যকায় না থাকে তবে কি সন্ত্রাস থামবে? মেহবুবাকে রাজনাথ বলে এসেছেন, না, না, এ বার আর বন্দুক নয়, আলোচনায় বসব শান্তি ফেরাতে।

Advertisement

মেহবুবা ঘর পোড়া গরু। তবে যে দিন দিল্লি এসে মেহবুবা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন সে দিনও মুখ্যমন্ত্রীকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ১৫ অগস্ট লালকেল্লার বক্তৃতাতেও তো প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরিদের গলায় লাগানোর কথা বলেছেন। অনেকেই ভাবছেন, কাশ্মীর নিয়ে তবে কি মোদী সরকার কৌশল বদলাচ্ছে? দমননীতির বদলে আলাপ আলোচনা শান্তি প্রক্রিয়া?

আসল ব্যাপারটি কী?

Advertisement

আমার মনে হচ্ছে, সরকার বাহাদুরও বুঝতে পারছেন, গুলি চালিয়ে এই রক্তবীজের জন্ম প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করা যায় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কিছু অফিসার অবশ্য বলছেন, আমরা কাশ্মীরে জঙ্গিদের কার্যত শেষ করে দিয়েছি। এখন তো জঙ্গির সংখ্যা ১৯০। এখন আর সংঘাতে না গিয়ে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু এ কথা সরকারি ভাবে বলা হলেও বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু আলাদা। ২০০০ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল পদ্মনাভনও বলেছিলেন, জঙ্গি সংখ্যা কত? তখন ছিল ১৭ হাজার। আর ভারতীয় সেনা তো চার লক্ষ। তা হলে জঙ্গি নির্মূল করা তো কোনও ব্যাপারই নয়। তার পর কী হল? জঙ্গি হত্যা হল অনেক। কিন্তু সন্ত্রাস কি স্তব্ধ হল? আবার কিছু দিনের বিরতির পর জঙ্গি সংখ্যা বাড়তে থাকে। আসলে জঙ্গি দমনে সমস্যার সমাধান হবে না যত দিন না কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতার অবসান হবে, তত দিন এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না।


অশান্ত কাশ্মীর।— ফাইল চিত্র

মেহবুবাকে বহু দিন ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখছি। মেহবুবার বাবা মুফতি সাহেবকে মনমোহন সিংহ ভারতীয় প্রতিনিধি দলের প্রধান করে রাষ্ট্রপুঞ্জেও পাঠান। সনিয়া গাঁধীও মুফতির মাধ্যমে কাশ্মীরিদের সঙ্গে সেতু রচনা করেছিলেন। এমনকী আবদুল্লা বা গুলাম নবি আজাদ— সরকার যারই হোক। মেহবুবা আধুনিক মানুষ। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত। সংসদে থাকার সময়ে তাঁর শাহজাহান রোডের বাংলোতে যখন যেতাম, দেখতাম ওঁর মেয়ে শ্রীনগরে থাকলেও দিল্লি এসে খান মার্কেটে শপিং করতে ভালবাসে। আর ম্যাকডোনাল্ডসের ফাস্ট ফুড খুব ভালবাসত।

মোদীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার কাশ্মীরে অন্য পথে এগোতে সচেষ্ট।

রাও থেকে বাজপেয়ী, সেখান থেকে মনমোহন, প্রত্যেকেই হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে কথা বলার প্রক্রিয়া চালিয়েছেন। মোদী জমানায় অজিত ডোভাল ‘ডকট্রিন’ ছিল ভিন্ন। তাঁর মূল তত্ত্ব ছিল, কাশ্মীরে প্রথম বার্তা দিতে হবে, হোয়াট ইউ ওয়ান্ট টু অ্যাচিভ দ্যাট ইস আনঅ্যাচিভেবল।

আবার সরকারি কাউন্টার ইনসার্জেন্সিরও অনেক রকম কৌশল হয়। ব্রিটিশ পদ্ধতি ছিল, নেতাদের হত্যা না করে নিচুতলার জঙ্গিদের হত্যা কর। তার পর নিচুতলার জঙ্গিরা অনেকটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে নেতাদের ডেকে কথা বল। আমেরিকার পদ্ধতি ভিন্ন। আমেরিকানরা যে হেতু নিজের দেশের বাইরে অন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রে অনেক সময় এই ধরনের অপারেশন চালায় তাই তারা প্রথমেই বড় বড় নেতাদের হত্যা করে সন্ত্রাস দমনে সচেষ্ট হয়। অজিত ডোভাল বাহিনী এ বার কাশ্মীরে এই আমেরিকান পদ্ধতি গ্রহণ করে। ফলে, গত এক বছরে বহু শীর্ষ জঙ্গি নেতা, কম্যান্ডারদের ভারতীয় বাহিনী গৃহবন্দি করে রেখেছে। প্রবীণ গিলানির পুত্র ও জামাইয়ের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও আয়করের মামলা দিয়ে স্থানীয় মানুষের কাছে তাদের ভাবমূর্তিও নষ্ট করতে চেয়েছে। তাতে সন্ত্রাস কি থেমেছে! দক্ষিণ কাশ্মীরে এখন শুধু শীর্ষনেতা নয়, নাম না জানা বহু যুবক হাতে অস্ত্র ধরেছে, জঙ্গি আন্দোলনে নিযুক্ত হচ্ছে বহু কাশ্মীরি। তারা সবাই আইএসআইয়ের চর নয়। কাশ্মীরের আর্থিক দুর্গতি ও বিচ্ছিন্নতা হল এই বিদ্রোহের কারণ।

সেই সমস্যার সমাধান না করে আরএসএস সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫-এ, এই দুই অনুচ্ছেদ তোলার জন্য আদালতে একের পর এক মামলা করে যাচ্ছে। লাক্ষাদ্বীপের বিজেপি-র জাতীয় সচিব ফারুক খান সঙ্ঘের নির্দেশে জম্মু বেঞ্চে মামলা করেন, আরএসএস প্রভাবিত সংস্থা জম্মু-কাশ্মীর স্টাডি সার্কেলও একই আদালতে মামলা দায়ের করেছে। যখন টি এস ঠাকুর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন, তখন থেকে বিজেপি সচেষ্ট। তার পর বিচারপতি জে এস খেহর, এখন বিচারপতি দীপক মিশ্র। গত চার বছর ধরে বিজেপির চেষ্টা, সরকার নিরপেক্ষ অবস্থান নিক, আর আদালতের মাধ্যমে ৩৭০ ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ এবং বিশেষ ক্ষমতা খতম করে দেওয়া হোক। ২০১৯-এর আগে তা হবে বিজেপির এক মস্ত বড় সাফল্য।

হায়! নীতি প্রণয়নের সময় দেশটার মানুষের কথা কেউ ভাবছেন না। শুধু ভোটের কথাই ভাবা হচ্ছে। তাই মতাদর্শের কাউন্টার হিন্দুত্ব ন্যারেটিভ আর সেনাবাহিনীর দমন এই রেসিপিতে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান তিন বছরে হল কই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন