গণতন্ত্রের পথে, তারই মুখোশে

তুরস্কের অর্থনীতি সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বগামী। ডলারের সাপেক্ষে রেকর্ড পতন ঘটেছে তুর্কি মুদ্রা লিরার। বাড়ছে বেকারি। এর্দোগানের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র হরণের বহু অভিযোগ।

Advertisement

পলাশ পাল

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share:

রিসেপ তায়িপ এর্দোগান

গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখে কী ভাবে একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে হয়, তার আদর্শ মডেল হতে পারেন রিসেপ তায়িপ এর্দোগান (ছবিতে)। দ্বিতীয় বার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়ে তিনি এতটাই ক্ষমতাশালী হয়েছেন, পছন্দমতো মন্ত্রী, আমলা ও বিচারকদের নিয়োগ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত, আইনি ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ও জরুরি অবস্থা জারির মতো ক্ষমতাও থাকছে প্রেসিডেন্টের হাতে। গত বছর গণভোটে দেশের ৫১ শতাংশ মানুষ এই পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন।

Advertisement

তুরস্কের অর্থনীতি সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বগামী। ডলারের সাপেক্ষে রেকর্ড পতন ঘটেছে তুর্কি মুদ্রা লিরার। বাড়ছে বেকারি। এর্দোগানের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র হরণের বহু অভিযোগ। ২০১৬-য় ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে জেলে পুরেছেন কমপক্ষে ১ লক্ষ ৬০ হাজার নাগরিককে। বহু বিরোধী নেতা হয় নিখোঁজ না হয় বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। অথচ প্রেসিডেন্ট হিসাবে এর্দোগানের পক্ষে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট এবং পার্লামেন্টে পিপলস অ্যালায়ান্স জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেই তাঁর জনপ্রিয়তা প্রমাণিত।

মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের দেশের মানুষ কেন এর্দোগানের মতো একনায়কসুলভ, উগ্র-জাতীয়তাবাদী, ইসলামপন্থী শাসককে বেছে নিলেন? অনেকেই দায়ী করেছেন ভোটারদের অদূরদর্শিতাকে। ঠিকই, ইতিহাস সব সময় শাসক নির্বাচনে জনতার বিচক্ষণতার পক্ষে সাক্ষী দেয় না। গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত হয়ে অনেক শাসকই বেছে নিয়েছেন একনায়কের পথ। নরেন্দ্র মোদী থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন থেকে হাঙ্গারির ভিক্টর ওরবান, প্রত্যেকেই নির্বাচিত শাসক, কিন্তু তাঁদের শাসনে অ-গণতন্ত্রের ছায়া স্পষ্ট। কিন্তু তাই বলে এই শাসকদের নির্বাচন করে জনগণ বোকামি করেছেন, এমন ধারণা হবে অতিসরলীকরণ। জনগণের ন্যায্য চাহিদা যদি দীর্ঘ দিন দাবিয়ে রাখা হয়, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি যদি সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়, তবে গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন ‘পপুলিস্ট’ শাসকরা এবং ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে ঠেলে দেন মৃত্যুর দিকে।

Advertisement

১৯৫০ সালে বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকেই তুরস্কের রাজনীতিতে ডানপন্থী ও বামপন্থী দলগুলিই পালা করে ক্ষমতায় আসত। কিন্তু ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র স্বঘোষিত অভিভাবক সেনাবাহিনী সব সময়ই নিজেদের রাখত পুতুলনাচের নিয়ামকের ভূমিকায়। ডানপন্থী ধর্মীয় দলগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা নানা সময়ে রাজনীতিতে নাক গলাত। মূলত, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র রক্ষার অজুহাতেই সেনাবাহিনী ১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ এবং ১৯৯৭— চার বার দেশের শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে।

২০০৩ সালে, পূর্বতন শাসক, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ গোষ্ঠী ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করে এর্দোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। ২০১৪ সালে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে টানা তিন দফায় বারো বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। প্রথম দিকে তিনি ছিলেন কিছুটা মধ্যপন্থী। ২০১৩ সালে গাজ়ির পার্ক আন্দোলন এবং ২০১৬-তে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান তাঁকে বেপরোয়া করে তোলে। ইস্তানবুলের তাকসিম স্কোয়্যারে গাজ়ির পার্কের গাছ কেটে সেখানে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের সরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন প্রতিবাদকারীরা। অচিরেই এই আন্দোলন প্রবল সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। এর্দোগানের অভিযোগ, গাজ়ির পার্ক আন্দোলন বা ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান, উভয়ের পিছনে ছিল কয়েকটি কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী এবং সেনাবাহিনীর কয়েক জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যাঁদের মদত জুগিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত ফেতুল্লা গুলেন ও তাঁর অনুগামীরা।

এর পর থেকেই এর্দোগান সামরিক বাহিনী থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করেন। বন্ধ করে দেন বহু সংবাদমাধ্যম। পাইকারি হারে গ্রেফতার করেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের। গণভোটের মাধ্যমে একব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠার পিছনেও ছিল নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চরম পদক্ষেপ। এখানেই থেমে থাকেননি এর্দোগান, নিজের শাসনকে পাকাপোক্ত করতে মোদী যে ভাবে প্রাচীন ‘হিন্দু’ ভারতের ঐতিহ্যের গল্প শোনান, ট্রাম্প শোনান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট আগেন’-এর কল্পকাহিনি, সে ভাবেই তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের উচ্চ প্রশংসা করেন, এবং জনতার মনে এই বিশ্বাস তুলে ধরেন যে, তাঁর শাসনে তুরস্ক ও তার মুসলিম সমাজ আবার মহান হয়ে উঠবে, ভোগ করবে অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরব।

এর্দোগানের পতন ঘটবে ইতিহাসের নিয়ম মেনেই। ইতিহাস শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রেরই জয়গান লেখে। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, কেন বিশ্ব জুড়ে পপুলিস্ট শাসকরা এত শক্তিশালী হয়ে উঠছেন, কেন ভোটারদের মন থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা দিনকে দিন উঠে যাচ্ছে, গণতন্ত্রের পথ ধরেই কেন বার বার উঠে আসছেন ছদ্মবেশী একনায়করা। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই আত্মসমীক্ষাটুকু দরকার। নতুবা মোদীর হিন্দুত্ববাদীরা, ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী সমর্থকরা যে বার্তা দিচ্ছেন তার মোকাবিলা করতে হলে, গণতন্ত্র ও সভ্যতা, উভয়কেই চড়া মূল্য দিতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন