রাম কি সত্য, না কবির কল্পনা? চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে নবমী তিথিতে নাকি তাঁর জন্ম হয়েছিল। অন্তত আদিকবি তা-ই লিখেছেন। রামের প্রধান প্রতিপক্ষ রক্ষকুল। রাবণকে পরাজিত করে, তাঁর কাছেই রাজনীতির পাঠ নিয়ে এবং তাঁকে বধ করে রাম তাঁকে যথাযোগ্য রাজকীয় সম্মানে দাহ করেছিলেন। অতঃপর অযোধ্যায় ফিরে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তাঁর অনুপস্থিতিতে ভরতের শাসনে দেশে শান্তি-সমৃদ্ধি ছিল অনুমান করি। কারণ অযোধ্যায় ফিরে রামকে নতুন করে দুষ্টের দমন করতে হয়নি। বরং সীতার সতীত্ব নিয়ে অনেক কাহিনি রচনা করতে হল।
পুরাণ বলে, রাম বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। তাতে আপত্তির কিছু নেই, কারণ মানবচেতনায় ঈশ্বরের নিরন্তর জন্ম-মৃত্যু ঘটে। একটুকরো পাথর, গাছ, ওলাবিবি, দক্ষিণরায়— তালিকা দীর্ঘ করার প্রয়োজন নেই। তবে শ্রীরাম, বজরংবলী, গদা, তলোয়ার, ত্রিশূল ইত্যাদি এমনই অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছে যে সরল ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মাচরণ জটিলতর রাজনীতির রূপ নিচ্ছে।
রাম সত্যি থাকুন বা না-ই থাকুন, ‘রামায়ণ’ মহাকাব্য আসলে এক রাজনৈতিক আখ্যান, ‘মহাভারত’-এর তুলনায় একটু ভক্তিরসে চুপচুপে এবং আবেগসজল, এই যা। কিন্তু এ-কথা তো মানতেই হবে, রাজা হিসাবে রাবণও সফল। সোনার লঙ্কা গড়েছিলেন। রক্ষকুল যথেষ্ট স্বাধীন ছিল। তবে রাবণ অহঙ্কারী। পণ্ডিত হয়েও নীতিভ্রষ্ট। নারীলোলুপ। পররাজ্যহরণবিলাসী! তাই শেষ পর্যন্ত দুষ্টের দমন হয় এবং বিষ্ণুর সপ্তম অবতার সাত হাজার (আনুমানিক) বছর পরেও রাজতান্ত্রিক দুনিয়া থেকে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের রাস্তায় অস্ত্রমিছিল করে হেঁটে যান! তাঁর নামে ভাঙচুর, হত্যালীলা, ঘৃণা ও বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরির মধ্যে কোথাও কোনও অনুশোচনা নেই। বাল্মীকির রাম দেবতা হিসাবে চরিত্রায়িত হননি। রাজা হিসাবে তাঁর দুর্বল দিকগুলিও রামায়ণে বর্ণিত আছে। রামকে দেবকল্প করেছে পরবর্তিকাল এবং স্বার্থসন্ধানী ক্ষমতালিপ্সু প্রতিষ্ঠানসমূহ। অলৌকিকের প্রতি ভয়-ভক্তি ব্যবহার করে ওঝা যেমন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আদায় করে, এই প্রতিষ্ঠানগুলি তার ব্যতিক্রম নয়। রামের বা হনুমানের নব্য নায়কত্ব নির্মাণে যুক্তিবোধ ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার কোনও স্থান নেই। কারণ তাতেই বিভেদ ও বিদ্বেষমূলক রাজনীতির সুবিধা। ব্যক্তিপূজাপ্রবণ হিন্দু বা হিন্দুত্ব প্রভাবিত ভারতীয় জনগণের মনস্তত্ত্ব ধর্মের নামে বারংবার অপব্যবহৃত হয়েছে, ঠিক যেমন ধর্মের নামে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদী কর্তৃত্ব চালায় বিভিন্ন উগ্রপন্থী প্রতিষ্ঠান! এই সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা, মানুষের মধ্যে নিহিত ক্ষমতালোভ ও প্রভুত্বকামনা।
আজ যে শিশুদের হাতে ধর্মের নামে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়, তারা কি এই শিক্ষা পায়, সব ধর্মের মূলকথা শান্তি, দয়া, মৈত্রী ও ভালবাসা? তাদের কি বোঝানো হচ্ছে, অস্ত্র আত্মরক্ষার উপকরণ, আক্রমণের নয়! ধর্মের নামে যে জনসাধারণকে মাতিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষের দাহ্য স্তূপ গড়া চলছে, তাদের এই বার্তাটি দেওয়া হচ্ছে কি, ধর্ম মানে ঈশ্বরকে কে কোন নামে ডাকল তা নয়, ধর্ম একটি রাস্তা, যার মধ্য দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে মানুষ আসলে শান্তির সন্ধান করে!
এমনকী ধর্ম যদি কেউ না-ও মানেন, যে-ধর্ম ঈশ্বরের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে তার উপর আদৌ বিশ্বাস না-ও রাখেন, তাতেও কিছু এসে যায় না। কমিউনিস্ট পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা প্রতিরোধ করা গিয়েছিল কারণ কমিউনিস্টরা ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাসী নয় এবং তারা সাম্যের জয়গান গায় এই ভাবমূর্তি জারি রাখা ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। এ ছিল তাদের কাছে অস্তিত্বের লড়াই। আর কোনও রাজনৈতিক দলেরই সেই দায়বদ্ধতা নেই।
ধর্ম, হওয়া উচিত ছিল, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আচরণীয় কিছু রীতি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মানুষের ইতিহাসে ধর্ম শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের রূপ নিয়েছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক নীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে এবং নিয়ন্ত্রণ করেছে। ধর্ম ও রাজনীতি পরস্পরকে ব্যবহার করে, পরস্পরের প্রতি নির্ভর করে এবং শাসায়!
সাধারণ মানুষ যত বেশি শিক্ষিত ও সচেতন হবে, এই প্রাতিষ্ঠানিক আঁতাঁত তত বেশি করে ভাঙবে। আমাদের বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে কৃপাণ, তিরধনুক বা লাঠি-তলোয়ারের প্রতীকী ব্যবহার আছে। তার মানে কি এই যে, জনতা সারাক্ষণ শস্ত্রভূষিত থাকবে! কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, ধর্ম কী, অধর্মই বা কী তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা আছে আমাদের পুরাণ ও মহাকাব্যগুলিতে। তার দার্শনিকতা উপলব্ধি করার মতো আমজনতা যদি বিগত ৭১ বছরের স্বাধীন ভারতে তৈরি হত, তা হলে রাম-সীতা সাজিয়ে ভোটের প্রচার কোনও কাজে আসত না। রামনবমীর মারণমিছিলও না। এ দেশে কোটি কোটি টাকা তছরুপ হয়, প্রকাশ্যে ভোট কেনাবেচা, নির্লজ্জ আদর্শহীন নেতা-নিলাম হয়, প্রত্যেকবার নির্বাচন এলেই ধর্মের নামে উত্তেজনা ছড়ানো এবং পারিতোষিক বিতরণের যুগপৎ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কিন্তু ইরাকে বেঘোরে প্রাণ দেওয়া অসহায় ভারতীয়দের সম্পর্কে আশ্চর্য নীরবতা! শিক্ষার খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ে না। ডিজিটাল ইন্ডিয়া আসলে এক ফুৎকার! আজ পর্যন্ত কোনও শাসকদলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও এই সদিচ্ছা প্রদর্শন করেনি যাতে ভারতবাসীর শিক্ষা সার্বিক ও যথাযোগ্য হয়। তোমাকে দৃষ্টি দেব না, বরং তোমার চোখ উপড়ে নেব, যাতে আমার কুৎসিত মুখ তুমি দেখতে না পাও। বেসরকারি পন্থায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ ব্যয়বাহুল্য, সারা দেশে যে পরিমাণ বেকারত্ব, তা প্রশাসনিক ব্যর্থতার চূড়ান্ত উদাহরণ!
রামনবমী ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে যা ঘটে গেল তা এক বড় ঝড়ের পূর্বাভাস। দাঙ্গা বা রক্তক্ষয় যেখানে যতখানি হয়েছে, সত্যিই কি এড়ানো যেত না? গোয়েন্দা দফতরের কোনও দায়িত্ব ছিল না আগাম অনুমান করার? হয়তো সবাই জানতই যে তোষণের ভাগাভাগিতে সব দলই থাবা বসাবে। ভোট-ব্যবসায়ের মূলধন যে জনতা! সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর মধ্যে তোষণের ভারসাম্য রাখতে গেলে যা যা করতে হয়, রাজনীতি তা করে। আদ্যন্ত অসৎ রাজনীতির মধ্যে জনতা ও জননেতা সকলেই সামিল! কলুষিত রাজনীতি সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সাধারণ নাগরিকের এক বিরাট অংশ তার দায় এড়াতে পারে না! রামনবমী পালনের ঘটা ধর্মকর্ম কিছু নয়, আসলে জমিদখলের দুই অন্ধকার সুড়ঙ্গ খোঁড়া চলছে। একদল প্রমাণ করতে চাইছে হোক দাঙ্গা, দেখুক লোকে প্রশাসন কত দুর্বল, আমরা কত বলবান! আবার প্রশাসনিক দলও হয়তো ভাবছে দাঙ্গা হোক, দেখুক লোকে, ওই দল ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গের দশা কী হবে!
তাই গোটাকয়েক মৃত্যুর পর পুলিশকে তৎপর হতে বলা হল। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হবে, উদ্ভ্রান্ত, বিক্ষুব্ধ বেকারের দল উলুখাগড়ার মতো মরবে!
বন্ধ হোক এই ঘৃণ্য মৃত্যুপণের রাজনীতি!