Krishna Bose

‘সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে সত্য উচ্চারণে কখনও দ্বিধাবোধ করেননি’

মাসিমার বিয়ে হয়েছিল কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত পরিবারে—যে পরিবারের সন্তান ছিলেন বাংলার সবথেকে জনপ্রিয় আইকন সুভাষচন্দ্র বসু।

Advertisement

রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৮:৪৪
Share:

কৃষ্ণা বসু। —ফাইল চিত্র।

কৃষ্ণা বসু আমার কাছে ‘মাসিমা’। কারণ, ওঁর বড় ছেলে সুগত আমার বন্ধু। সুগত প্রেসিডেন্সিতে আমার কয়েক বছরের জুনিয়র ছিল। মাসিমাও প্রেসিডেন্সির ছাত্রী। ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায় যখন সেই কলেজের দরজা মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত হয়, সেই সময়কার। প্রেসিডেন্সি কলেজ নিয়ে তাঁর গল্পের ভাঁড়ার ছিল অফুরান। মাসিমার কথা ভাবতে বসলে যেটা সবার আগে মনে আসে, তা হল গল্প। বন্ধু, পরিজন আরও নানা বিষয়ে আনন্দময় গল্প।

Advertisement

মাসিমার বিয়ে হয়েছিল কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত পরিবারে—যে পরিবারের সন্তান ছিলেন বাংলার সবথেকে জনপ্রিয় আইকন সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে যে, মাসিমার বাপেরবাড়ির ঐতিহ্যও কিছু কম ছিল না। মাসিমার বাবা চারুচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন সংবিধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।যাঁর তৈরি বেশ কিছু নিয়ম আজও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় অনুসৃত হয়। জ্যোতি বসু যখন তরুণ তুর্কি বিপ্লবী নেতা হিসেবে রাজ্য বিধানসভায় প্রবেশ করেন, তখন সাংবিধানিক বিষয়ে অনেক কিছুর পাঠই তিনি নিয়েছিলেন চারুবাবুর কাছে। প্রখ্যাত নীরদচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন মাসিমার কাকা। বাপেরবাড়ির ব্যাপারে মাসিমা বেশ গর্বিতই ছিলেন, যদিও তাঁর নেতাজি সংক্রান্ত পরিচিতিটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, অন্তত তাঁর নিজের সাংসদ হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত তো বটেই।

মাসিমা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছিলেন ইংরেজি নিয়ে। পরে সিটি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর সাদাসিধে চেহারা দেখে বোঝার উপায় ছিল না, কী পরিমাণ সাহস আর এনার্জি তিনি ধারণ করতেন। এই সাহসের একটা বড় উদাহরণ— তিনি সুভাষচন্দ্র এবং তাঁর প্রেমিকা (পরে পত্নী) এমিলি শেঙ্কলের চিঠিপত্র সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রগুচ্ছের একাংশ বাংলায় অনূদিত হয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে এই অনুবাদ্গুলিকে সুভাষচন্দ্রের একদল গোঁড়া সমর্থক অগ্নিদগ্ধ করেন। এঁরা বিশ্বাস করতেন না যে, সুভাষের জীবনেও প্রেম আসতে পারে এবং তিনি বিয়ে করতে পারেন! কিন্তু এই অন্ধত্ব মাসিমাকে দমাতে পারেনি। তাঁর যা সত্য বলে মনে হয়েছিল, তিনি তা-ই করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে কোনও সত্য উচ্চারণ করতে তিনি কখনও দ্বিধাবোধ করেননি।

Advertisement

বিয়ের দিন।ছবি: কৃষ্ণা বসুর ওয়েবসাইটের আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

আরও পড়ুন: ‘সাইকেল চড়ে ফুরফুরে হাওয়ায় কৃষ্ণাদি এগিয়ে যাচ্ছেন দিল্লির পথে’​

নির্বাচনী প্রচারে আর লোকসভার অধিবেশনে তাঁর উদ্যম ছিল দেখার মতো। তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্র যাদবপুরের গ্রাম ও মফস্‌সল তিনি চষে ফেলতেন। জন্ম এবং বিবাহসূত্রে তিনি এগিয়ে থাকা পরিবারের সদস্য হলেও নির্বাচনী প্রচারের সময়ে যে কোনও কৃচ্ছসাধনে তিনি পিছপা হতেন না। সাংসদ হিসেবেও মাসিমা ছিলেন আদ্যন্ত সিরিয়াস। লোকসভার অধিবেশনে তিনি অনুপস্থিত হতেন না বললেই চলে। সংসদীয় কমিটিগুলির কাজও যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে সামলেছেন বরাবর।

অমর্ত্য সেন ও শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

এই লেখা আমি শুরু করেছিলাম গল্প-বলিয়ে মাসিমার কথা দিয়ে। এই গুণটিকেই খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর স্মৃতিকথায়। তাঁর স্মৃতির বিপুল ভাঁড়ারের অংশবিশেষই তিনি প্রকাশ করেছিলেন। ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির অন্তরাত্মাকে তিনি জানতেন। এর বিলয়ে কলম ধরতে কখনও দ্বিধা বোধ করেননি তিনি। ঐতিহ্যের আলো যখনই নিভে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, জ্বলে উঠেছেন তিনি।

আরও পড়ুন: প্রাক্তন সাংসদ ও শিক্ষাবিদ কৃষ্ণা বসুর জীবনাবসান​

অনেকের মতো আমিও তাঁর অপার স্নেহ পেয়েছি। তাঁর অভাব সর্বদা বোধ করব। অভাব বোধ করব তাঁর সাহসিকতা আর অমলিন হাসির, যা দিয়ে তিনি মানুষকে কাছে টেনে নিতেন।

লেখক: আচার্য, অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন