নোট বাতিলের ফল যে দেশের পক্ষে ভাল হয় নাই, তথ্য ও পরিসংখ্যান তাহা প্রমাণ করিয়া চলিয়াছে। তাহা হইলে, যে কোটি কোটি দেশবাসী নোট বাতিলের সুফলের প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াইলেন ও দৈনন্দিন জীবনের আত্যন্তিক অসুবিধা হাসিমুখে ও আশান্বিত চিত্তে সহ্য করিলেন, তাঁহাদের ক্রোধান্বিত হইয়া হইহই বাধাইবার কথা। তাহার পরিবর্তে সকলেই বিরাট কোহালির শতরানে মুগ্ধ হইয়া আছেন। তবে কি এই দেশ রাগিতে জানে না? কতকটা তাহাই। যে দেশে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের দল সারা দিন ধরিয়া ফুটপাতে শুইয়া নিশ্চুপ নয়নে ধীরে ধীরে মরিয়াছে, কিন্তু কোনও ভাবেই সম্মুখের মিষ্টান্নের দোকানে হানা দেয় নাই, সেই দেশ হয়তো স্বভাবত ভীরু ও প্রতিরোধহীন। সম্মুখে দাঁড়াইয়া চক্ষে চক্ষু রাখিয়া ‘জবাব দাও’ বলিতে মেরুদণ্ডের জোর লাগে। বহু নির্বিরোধী মানুষ, তাঁহার প্রতি অন্যায় হইতেছে— পুরাপুরি বুঝিয়াও অন্যায়কারীর মুখের উপর প্রতিবাদ করিতে পারেন না। বস্তুত এই সমাজে ভালমানুষির প্রচলিত সংজ্ঞা ইহাই। যে-মানুষটি সকলই মানিয়া লওয়াকে, মানাইয়া চলাকে নিজ ধর্ম করিয়াছেন, তিনিই ভাল। কিন্তু অন্যায় যে সহে, সে শেষাবধি ভাল লোক নহে, কারণ তাহার নীরবতার প্রশ্রয়ে অন্যায় রাজ্য বিস্তার করে। নোট বাতিল জনজীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় ডাকিয়া আনিয়াছিল, তাহা যদি নিষ্ফলা হইয়া থাকে তবে অভূতপূর্ব গর্জন ঘটিলেই সুসমঞ্জস হইত। কিন্তু ঘটিল না। হয়তো দেশের অধিনায়কগণ দেশবাসীর এই অপারগতা সম্বন্ধে যথেষ্ট অবগত এবং সে কারণেই প্রবল বিঘটন ঘটাইবার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী।
আরও বড় কথা, জনসাধারণের স্মৃতিশক্তি অবিশ্বাস্য ক্ষীণ। বিশেষত ইদানীং তাহার মোবাইলে প্রতিনিয়ত সংবাদ, তথ্য, রসিকতা, ছবি, মন্তব্যের এমন ঝটিকা ঘটিতে থাকে, তাহাতে তাহার পক্ষে গত সপ্তাহের ঘটনাই স্মরণে রাখা কঠিন। এক মাস পূর্বের ঘটনাকে তো প্রাগৈতিহাসিক মনে হয়। গত বৎসর নভেম্বরের মহাকষ্টের স্মৃতিও হয়তো জুড়াইয়া আসিয়াছে। এটিএম-এর দীর্ঘ লাইনগুলি এখন পিকনিকের ন্যায় মনে হয়। তাহা ব্যতীত, এই দেশের জনতার নিকট পরিসংখ্যান বস্তুটি অতি জটিল ও মহা একঘেয়ে। তাঁহারা নাট্য বুঝেন, নীরস সংখ্যা বুঝেন না। তাঁহাদের নিকট একটি ঘটনা একমাত্রিক, যাহার একটি সংক্ষিপ্ত নীতিকথা আছে। নোট বাতিলের নীতিকথা: মোদীর প্রকাণ্ড সাহস, তিনি ধনীদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে এতটুকু ভয় পান না। নোট বাতিলের ফলে দেশের কত টাকা অপচয় হইল, আর্থিক বৃদ্ধি কতটা কমিল, মনমোহন সিংহ পূর্বেই কী বলিয়াছিলেন, ইহাতে ভারতের জনতার কিছুই যায় আসে না। সকল তথ্য পার হইয়া সেই যে মোদীর ধনীঘাতী বৈষম্যনাশী মূর্তিটি জাগরূক রহিয়াছে, উহাই পূজিত হইবে। যদি চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া দেখানো হয়, আর্থিক বৈষম্য ইহাতে ঘুচে নাই, কিছু তারতম্য হইবে না। পোস্ট-ট্রুথের জমানায়, ‘কী মনে হইল’ উহাই আসল, ‘কী মনে হওয়া উচিত ছিল’ আস্তাঁকুড়ে নিক্ষিপ্ত হইবার ধারণা।
বরং প্রতিবাদ হইলে পূজার সময়ে বৃহৎ গোলমাল উপস্থিত হইত। প্রতিবাদের কথা শুনিলেই ভারতের মানুষের হৃৎকম্প ঘটে, কারণ তাহার অর্থ পথ রোধ করিয়া মিছিল, অবর্ণনীয় যানজট, অ্যাম্বুল্যান্সে রোগীর বেঘোরে মৃত্যু, স্কুলবালিকার ক্ষুধার্ত ক্রন্দন, ইন্টারভিউয়ে পৌঁছাইতে না-পারা, বিমান ধরিতে না-পারা। প্রতিবাদ যাঁহারা করেন, বারংবার সাধারণ মানুষের দোহাই দিলেও, তাঁহারা নিজ দলের সমর্থকদের লইয়া প্রতিবাদ করেন, মানুষ লইয়া তাঁহাদের প্রকৃত মাথাব্যথা নাই। আবার সাধারণ মানুষও, ভারতের রাজনীতি দেখিয়া এমনই ভয় পাইয়া গিয়াছেন, বেশ কিছু গুন্ডা-বদমায়েশ ও পূর্ণ অশিক্ষিত যে নেতা হইয়া ছড়ি ঘুরাইতে পারে তাহা বুঝিয়া এমনই হতচকিত ও হতোদ্যম হইয়া পড়িয়াছেন, কোনও প্রতিবাদে শামিল না হইয়া নিজ ঘরটিতে বসিয়া টিভি দেখাই তাঁহাদের একমাত্র কর্তব্য বলিয়া ধরিয়া লইয়াছেন। এই বন্দোবস্তে রাজনৈতিক দলগুলিরও পরিপূর্ণ সায় আছে, কারণ মানুষকে লইয়া মানুষের ভাল করিতে গেলে বিলক্ষণ ঝামেলা ঘটে। তাই সাধারণ মানুষের নিকট প্রতিবাদ এক উন্নতির উপায় নহে, নির্ভেজাল বিড়ম্বনা মাত্র। নোট বাতিলের ফলে যে অসুবিধা হইয়াছিল, তাহা লইয়া প্রশ্ন করিতে হোয়াট্সঅ্যাপে রসিকতা চালাচালি করিলেও, প্রতিবাদের অসুবিধার মধ্য দিয়া আর এক বার যাইতে পারিবেন না।
যৎকিঞ্চিৎ
রামরহিম কেঁদে বললেন, মাফ করে দাও। বিমল গুরুঙ্গ পুলিশ এসেছে শুনে জুতো ফেলেই পালালেন। রামদেব বাবা এক বার সালোয়ার কামিজ পরে শিষ্যাদের দলের সঙ্গে মিশে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। যাঁরা নিজেদের বহু মানুষের নেতা মনে করেন, তাঁরা পরাজয়ের কালে এমন সাধারণ প্রাণীর মতো ব্যবহার করলে তো মুশকিল। জননায়ককে ইমেজ রক্ষার্থে চরম বিপর্যয়েও (বিশেষত তখনই) আত্মমর্যাদাময় আচরণ করতে হবে, পেট যতই গুড়গুড়। মহিষাসুরকে দেখে শিখুন! a