State news

সুষ্ঠু নির্বাচনে লাভই হয়, ক্ষতি নয়, শাসক বুঝবেন কি?

অবশেষে দিগন্তরেখা দৃশ্যমান হল। বাংলার পঞ্চায়েতের আকাশে কী ঘটতে চলেছে, তা চূড়ান্ত হওয়ার একটা অবকাশ তৈরি হল।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৮ ০০:২৭
Share:

প্রতীকী ছবি।

অবশেষে দিগন্তরেখা দৃশ্যমান হল। বাংলার পঞ্চায়েতের আকাশে কী ঘটতে চলেছে, তা চূড়ান্ত হওয়ার একটা অবকাশ তৈরি হল।

Advertisement

কলকাতা হাইকোর্টে পঞ্চায়েত সংক্রান্ত মামলার শুনানি শেষ। আজ ঘোষণা করবে আদালত। নির্বাচনী প্রক্রিয়া কী ভাবে এগোবে, অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগের কী বিহিত হবে, নির্বাচন কমিশনের প্রতি হাইকোর্টের কোনও পরামর্শ থাকবে কি না— সবই আজ স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে যতখানি কাঠখড় পুড়ল, প্রলম্বিত অচলাবস্থা দেখা গেল, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি যে ভাবে পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিল, তা মোটেই কোনও সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।

এই দীর্ঘ অচলাবস্থার দায় কিন্তু সর্বাগ্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপরেই বর্তায়। পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্ব কমিশনের। নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর থেকে রাজ্যের প্রশাসনও আইনত কমিশনের অধীনস্থ। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে, প্রশাসনকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে এবং বিরোধী দলগুলির মনোনয়নপত্র বিনা বাধায় জমা পড়া নিশ্চিত করতে কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন যদি সাফল্যের সঙ্গে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারত, তা হলে হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়াইত না মামলায়। নির্বাচনী প্রক্রিয়া মাঝপথে আটকে যাওয়ার প্রশ্নই উঠত না।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

নির্বাচন বিলম্বিত এবং প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়ার দায় কিন্তু রাজ্যের শাসক দলও এড়াতে পারে না। বিরোধীদের যাবতীয় অভিযোগের তির শাসক দলের দিকেই। শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতীরা রাজ্য জুড়ে ত্রাসের পরিবেশ কায়েম করে রেখেছে, গ্রামে গ্রামে সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বর শাসানির মুখে পড়ছে, শাসক দল ছাড়া অন্য কেউ যেন মনোনয়ন জমা না দেয়, এমন অলিখিত বিধান বা নিদান বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, রক্তাক্ত হতে হচ্ছে বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থক থেকে নেতা-প্রাক্তন সাংসদকে— সন্ত্রাসের ভূরি ভূরি অভিযোগ শাসক দলের বিরুদ্ধে। এত কিছুর মধ্যেও যাঁরা মনোনয়ন জমা দিতে পারলেন, তাঁদের উপরে এখন প্রবল চাপ প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য। হাইকোর্টের নির্দেশে যাবতীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থগিত না হয়ে গেলে, এত দিনে অধিকাংশ এলাকায় বিরোধীদের দিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়ার কাজটাও সম্ভবত সেরে ফেলা হত। শাসক দল যদি নিজের এই চরম আগ্রাসী রূপটা না দেখাত, তা হলে নির্বাচন নিয়ে এত জটিলতার অবকাশই তৈরি হত না।

আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত ভোট কবে? আজই চূড়ান্ত রায় দেবে কোর্ট

পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের রায়দানের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে অতএব প্রশ্ন করতে হয়, জটিলতা এত বাড়িয়ে লাভ কী হল? প্রায় প্রতিটি জেলায় শাসক দল যে রকম উগ্রমূর্তি দেখিয়ে ফেলল, নির্বাচন কমিশনকে যে ভাবে ঠুঁটো করে রাখার চেষ্টা হল, যে ভাবে পুলিশ-প্রশাসনকে দলের অনুকূলে কাজে লাগানোর নির্লজ্জ প্রয়াস হল, যে ভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা হল, তাতে কি তৃণমূলের কোনও রাজনৈতিক লাভ হল? নাকি এ সবের আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল? এই চরম বিশৃঙ্খলা এবং হিংসার জন্ম না দিলে কি তৃণমূল নির্বাচনে জিততে পারত না? যে পরিস্থিতি তৈরি হল, তার মাধ্যমে কি তৃণমূল নিজের নিরঙ্কুশ জয় সুনিশ্চিত করে ফেলল?

হাইকোর্টের রায় ঘোষিত হওয়া মাত্রই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি কেটে যাবে, নির্বাচনী সন্ত্রাস মুছে যাব, রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ এমনই ভাবতে শুরু করেছেন, তা মোটেই নয়। তাই প্রশ্ন হল, এই রকম শ্বাসরোধী পরিবেশ যে কোনও উপায়ে বহাল রেখে যদি নির্বাচনটা দখল করে নেওয়া যায়, তা হলে মোক্ষ লাভ হয়ে গেল, এমনটা তৃণমূল ভাবছে কেন?

গত সাত বছরের শাসন কালে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সংখ্যা কম নয়, সে কথা ঠিক। কিন্তু সাফল্যও তো রয়েছে বেশ কিছু পরিসরে। উন্নয়নমূলক কাজ দ্রুত এগিয়েছে এই রাজত্বে। কখনও জেলা, কখনও ব্লক স্তরে পৌঁছে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা দেখভাল করার চেষ্টা করেছেন রাজ্যের শীর্ষ প্রশাসক। বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস দেখা গিয়েছে। এগুলোই তো সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারত পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো যুদ্ধে। গুলি-বোমা-হাঁসুয়া-টাঙ্গি-লাঠির প্রয়োজন তো পড়ত না। কিন্তু শাসক দল সম্ভবত নিজের কৃতিত্বে নিজেই ভরসা রাখতে পারল না। অথবা কৃতিত্বে ভরসা রেখেও নিজেদের ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে বড় বেশি ভয় পেয়ে গেল। তাই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে নির্বাচন দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করল।

হাইকোর্টের রায় আসার পর পরিস্থিতি বদলে যাক, নির্বাচনী প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে এগোক, গ্রাম-বাংলা অবাধে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করুক। কাম্য এমনটাই। তবে তার জন্য শাসক দলকে বুঝতে হবে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনটাই সবচেয়ে বড় উৎসব। সে উৎসব যদি অরাজক হয়ে ওঠে, যদি জনসাধারণ নির্বিঘ্নে সামিল না হতে পারেন সে উৎসবে, তা হলে প্রতিক্রিয়াটা সুখকর হয় না। নির্বাচনী ফলাফল হয়ত সাময়িক ভাবে সাফল্যের ছবিই তুলে ধরে। তবে তা নিতান্তই সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ক্ষতিটা সুনিশ্চিত হয়ে যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement