— ফাইল চিত্র।
যে পথ লইলে লক্ষ্যের সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী হওয়া যায়, তাহাকে বলে স্ট্র্যাটেজি: খানদানি মার্ক্স-লেনিনবাদী তত্ত্বেও এমন কথা পড়া যায়। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার ইতিহাস ঘাঁটিলে স্ট্র্যাটেজি তৈরির প্রয়াসের অপেক্ষা তাহার ঘাটতিটিই চোখে পড়ে বেশি। মোটামুটি একই দিকে তাহার গতি, একই নেতৃত্বে তাহার বিশ্বাস, এবং রাজনীতির দিক পরিবর্তনে তাহার ঘোর অনীহা। এই বাক্যের সপক্ষে প্রমাণ খুঁজিতে ইতিহাসের উজান বাহিয়া বহু দূর যাইবার দরকার নাই, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অতি-বিতর্কিত ভূমিকার কথা স্মরণ করিবারও প্রয়োজন নাই। সাম্প্রতিক অতীতে চোখ রাখিলেই তাহার স্ট্র্যাটেজি-বিরহিত স্থাণুত্বের প্রমাণ আপনি ধরা দিবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের খাতিরে যে সিপিএম নেতাদের মুখে নূতন কিছু ভাবিবার কথা শোনা যাইতেছে, নূতন স্ট্র্যাটেজির খোঁজ পড়িতেছে, ইহা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলিতে হইবে। হয়তো অনেক দেরি হইয়া গিয়াছে, তবু বিলম্বে চৈতন্যোদয়ও সামাজিক সচেতনতার দিক দিয়া নিশ্চয় মঙ্গলজনক। কয়েক দিন আগে সীতারাম ইয়েচুরিকে বলিতে শোনা গেল— ২০১৪ সালের পর বাস্তব অনেকখানি পাল্টাইয়াছে। মনে পড়িতে পারে, ২০১৮ সালের মধ্য ভাগ হইতে পার্টির রক্ষণশীলতার প্রবাদপুরুষ প্রকাশ কারাটও কয়েক বার এমন বাক্য উচ্চারণ করিয়াছেন। দেশের যে কয়েকটি রাজ্যে দলের হাতে ক্ষমতা ছিল, প্রায় সব কয়টিতে দল লোপ পাইতে বসাতেই হয়তো এমন উচ্চারণ তাঁহার পক্ষে— তাঁহার পক্ষেও— সম্ভব হইয়াছিল। ইতিমধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটাইয়া দিয়াছে, সকল জরুরি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয় ভুলাইয়া দিয়াছে। সেই চাপের ফলেই তাত্ত্বিক রক্ষণশীলতার বাহিরে আসিয়া সিপিএম নেতারা অবশেষে প্রায়োগিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতা দেখিতে পাইতেছেন। প্রশ্ন হইল, এই নবজাগ্রত বোধটিকে প্রয়োজনমতো জলসিঞ্চন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মনোযোগ দিয়া অন্বিত করা যাইবে কি না। যদি তাহা করা যায়, তবে বিলুপ্তপ্রায় দলটির আংশিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হইলেও হইতে পারে।
রাজনৈতিক বাস্তবের সহিত তাল রাখিতে না পারিবার ফলে যে কী ভাবে সিপিএমের রাজনৈতিক মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়াছে, গত এক দশকে তাহা নানা ভাবে দেখা গিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে সিপি(আই)এম পার্টি অনেক দিন ধরিয়াই ক্ষীয়মাণ, অনেক আগেই তাহাকে পুনর্জীবন দানের খাতিরে নূতন ভাবনা ভাবিবার কথা ছিল। দল কার্যত নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে, তবু তেমন ভাবনার দেখা মিলে নাই। ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের আগেও শাসক সিপিএম দুর্বল জায়গায় ছিল। অথচ সেই নির্বাচনে বিজেপিকে সর্বশক্তি দিয়া ঝাঁপাইতে দেখিয়াও সিপিএম বিকল্প স্ট্র্যাটেজির চিন্তা করে নাই। জনজাতীয় অঞ্চলে বিজেপির প্রবল প্রবেশ দেখিবার পরও জনজাতীয় দলগুলির সহিত বোঝাপড়া করে নাই, আইপিএফটির সহিত জোটের কথা ভাবে নাই। এই বৎসর জাতীয় নির্বাচনের আগে মহাগঠবন্ধনীভুক্ত দলগুলির সঙ্গে, ও পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে তাহারা কোন পথে অগ্রসর হইবে, দেখা যাউক। কিন্তু সীতারাম ইয়েচুরির মূল উপলব্ধিটিকে গুরুত্ব না দিলে তাঁহার দল বড় ভুল করিবে। তিনি ঠিকই ইঙ্গিত করিয়াছেন: বিরোধী পক্ষের ভোট যত বেশি ভাগে বিভক্ত হইবে, কেন্দ্রীয় শাসক দলের ততই সুবিধা হইবে। আঞ্চলিক শাসক দলের কথা আলাদা ভাবে বিবেচ্য। তবে, সিপিএমের ভাগ্যে জোট-কৌশল ভিন্ন ভোটের শিকা ছিঁড়িবার সম্ভাবনা নাই। ক্ষমতা যখন তলানিতে আসিয়া ঠেকে, অস্তিত্ব রাখিতে পুরাতন শত্রুতা ভুলিয়া স্ট্র্যাটেজীয় মিত্রতা জরুরি। কৌশল কথাটি তো কুশল (দক্ষ) হইতেই আসিয়াছে!