নাচ গান একতার উৎসব

‘সরহায়’ শব্দটি এসেছে ‘সারহাও’ থেকে, যার অর্থ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। সারা বছর গ্রামকে প্রয়োজনীয় খাদ্য দিয়ে সুস্থ রাখার জন্য পারিবারিক ও গ্রামের ‘বঙ্গা’দের (শুভ আত্মা) কৃতজ্ঞতা জানানো হয় এ পরবে।

Advertisement

বড় বাস্কে

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২২
Share:

সরহায় (সোহরায়) সাঁওতালদের একটি প্রধান উৎসব। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, বীরভূম, বর্ধমান জেলাসহ ঝাড়খণ্ড, অসম, নেপাল ও বাংলাদেশের সাঁওতালরা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও নাচগানের মধ্য দিয়ে, পৌষের শেষ থেকে পাঁচ দিন ব্যাপী এই পরব উদ্‌যাপন করেন। আদিতে এটি আশ্বিন-কার্তিক মাসে, কালীপূজার সময় পালন করা হত। অনুমান করা হয়, একদা তাঁদের বাসভূমি ছিল হাজারিবাগ এলাকা; সেখানকার ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী কৃষি-পঞ্জিকা ছিল ভিন্ন— আশ্বিনেই ধান কাটা হয়ে যেত, তার পরেই উৎসবের আয়োজন। কিন্তু তাঁরা ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাঁওতাল পরগনার উর্বর নিচু-জমির এলাকায় থিতু হলেন, চাষের প্রকৃতি বদলে গেল— ধান কাটা সারা হতে হতে পৌষ মাস। ১৮৫৫-র সাঁওতাল বিদ্রোহ (হুল)-এর পর থেকে সাঁওতাল পরগনার অধিবাসীদের দেশান্তর শুরু হল, কিন্তু তাঁরা সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর এবং ওডিশার সাঁওতালরা এখনও— মানে নিয়ম— পুরনো প্রথায় কালীপূজার সময় এই পরব উদ্‌যাপন করেন।

Advertisement

‘সরহায়’ শব্দটি এসেছে ‘সারহাও’ থেকে, যার অর্থ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। সারা বছর গ্রামকে প্রয়োজনীয় খাদ্য দিয়ে সুস্থ রাখার জন্য পারিবারিক ও গ্রামের ‘বঙ্গা’দের (শুভ আত্মা) কৃতজ্ঞতা জানানো হয় এ পরবে। প্রথম দিনটাকে বলা হয় ‘উম হিলোঃ’, স্নানের দিন। সকলে নিজেদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, পরবের জন্য প্রস্তুত হন। গ্রামের সামাজিক প্রধান বা মাঞ্জহি হাড়াম-এর নির্দেশে, বার্তাবাহক বা গোডেৎ ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে, প্রত্যেক বাড়ি থেকে এক পোয়া চাল, এক মুঠো ডাল, চার-পাঁচটা আলু, কিছু তেল, লবণ, লংকা, জ্বালানি কাঠ ও একটা মুরগির ছানা সংগ্রহ করা হয়। গ্রামের বাইরের মাঠে একটি পূজার স্থান (গঠ টান্ডি) তৈরি করা হয়। সেখানে গ্রামের পুরোহিত বা নায়কে পূর্বপুরুষদের আত্মার স্মরণে গ্রামের সব বঙ্গাদের নামে মুরগিছানা বলি দেন। পূজার পর উপস্থিত সকলে সেই সংগৃহীত চাল-ডাল খিচুড়ি করে, ওখানেই খান। বিকেলে নায়কে একটি ডিম মাঠের মধ্যে রেখে, তার উপর দিয়ে গ্রামের রাখালদের গরুর পাল ডাকিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। যাঁর গরুর পায়ে সেই ডিম লাগে, তাঁর পরিবারকে পরের মাসের মাঘ পরবে এক গোলা চালের মদ দিতে হয়। গরুর পায়ে ডিম লাগাটি পরিবারের পক্ষে শুভ বিবেচিত হয়। তার পর সকলে নায়কে-র পিছনে মাদল বাজিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেন।

দ্বিতীয় দিন ‘বঙ্গান হিলোঃ’, আত্মায় পরিণত হওয়ার দিন। পরিবারের লোকজন নিজেদের মধ্যেই বেশির ভাগ সময় কাটান। পরিবারের প্রধান সকাল থেকে উপবাস করেন এবং পারিবারিক বঙ্গার নামে বাড়ির সবচেয়ে ভাল মদ দিয়ে পূজা দেন। তার পর সেই মদ প্রথমে বাড়ির লোক এবং পরে প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাগ করে পান করা হয়। প্রত্যেকের বাড়িতেই মাছ-মাংস রান্না হয়, সন্ধ্যায় হয়তো গান হয়।

Advertisement

তৃতীয় দিন, ‘খুন্টাও’। গৃহপালিত পশুদের জন্য নির্দিষ্ট। সকাল থেকে প্রত্যেকে হাল কোদাল কুড়ুল কাস্তে জল দিয়ে পরিষ্কার করে তেল মাখিয়ে উঠোনে সাজিয়ে রাখেন। গরু-মহিষদেরও স্নান করানো হয় এবং তেল মাখিয়ে গ্রামের রাস্তায় খুঁটিতে বেঁধে ধান, শিষ, পিঠে বা লাড্ডুর মালা বানিয়ে শিং ও গলায় পরিয়ে, মাদল বাজিয়ে তাদের জন্য নাচগান হয়।

চতুর্থ দিন ‘জালে’, অর্থাৎ সম্পর্ক স্থাপনের দিন। সকলে দল বেঁধে গান করতে করতে গ্রামের রাস্তায় নেচে বেড়ান। কারও বাড়িতে নাচগান করতে করতে প্রবেশ করলে তাঁদের হাঁড়িয়া দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এ নাচগান সারা দিনরাত চলে। একসঙ্গে নাচগান করতে করতে বন্ধু বা প্রতিবেশীদের মধ্যে দূরত্ব বা মনোমালিন্য ঘুচেও যায়।

সাধারণত চতুর্থ দিনের পর একটি বিশ্রামের দিন রাখা হয়। এটাকে বলা হয় ‘হাকু-কাটকম’: মাছ আর কাঁকড়া খাওয়ার দিন।

শেষ দিন, ‘সাকরাৎ’। যে আত্মাদের প্রথম দিন পুজো দিয়ে বাইরে থেকে গ্রামে আনা হয়েছিল, আজ তাঁদের নিজ স্থানে দিয়ে আসা হয়। সকালে নায়কে পুরুষদের নিয়ে জঙ্গল শিকারে যান। বিকেলে ফিরে গ্রামের প্রান্তে মাঠের মধ্যে সকলে জড়ো হয়। সেখানে নায়কে-র স্ত্রীর তৈরি আতপ চালের তিনটে (বিজোড়) পিঠে একটা কলাগাছের খুঁটির উপর রেখে, দূর থেকে তিরবিদ্ধ করা হয়। যার অর্থ, যদি কোনও অশুভ আত্মা গ্রামে প্রবেশ করে, তাকে এই ভাবে ভয় দেখিয়ে বিতাড়ন করা হল। পরে গাছের খুঁটিটাকে কয়েক টুকরো করা হয় এবং যে ব্যক্তি পিঠেয় প্রথম তির মেরে মাটিতে ফেলেছিলেন, তিনি টুকরোগুলো কাঁধে নিয়ে এক অবিবাহিত পুরুষের কাঁধে চেপে গ্রামে প্রবেশ করেন। এই সময় রাস্তার উপর ছেলেমেয়েরা নানা রকম খেলা, শারীরিক কসরত দেখায়। তার পর সবাই গান করতে করতে মাঞ্জহি হাড়াম, নায়কে ও অন্যান্য মনোনীত ব্যক্তিদের বাড়ি যান, চালের মদ খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যান।

আপাতদৃষ্টিতে কেবল মদ খাওয়া ও নাচগানের পরব মনে হলেও, এর মধ্য দিয়ে সাঁওতাল জীবনদর্শনের একটা আভাস পাওয়া যায়। এটি সাঁওতালদের সমাজ-সংহত জীবনযাত্রার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সামূহিক জীবন একটি ক্ষমতা, যা তাঁদের এত যুগ ধরে বিবিধের মাঝে স্বতন্ত্র ভাবে নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন