কে চায় পুজিতে জ্যান্ত সাপ

কেন যক্ষ্মার আক্রমণ ২০১৮ সালেও চোখ কপালে তুলে দেয়, সেটা বুঝতে ক্যাথরিন অল্টার-ইভলিউশনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। কিছু প্রশ্ন তুলেছেন লেখক, যেগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক।

Advertisement

অনমিত্র বারিক

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৮ ০০:১১
Share:

প্রাকৃতিক সম্পদের উপর মানুষের সামূহিক অধিকারকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের একাধিকারে পরিণত করার বিষময় ফল কি শুধু আফ্রিকাকেই ভোগ করতে হচ্ছে? [আফ্রিকার পরিস্থিতি নিয়ে এই লেখার প্রথম পর্বে (‘জীবাণু, তুমি কোথা হইতে’, ২০-৬) আলোচনা করেছি।]ভোগ করতে হচ্ছে বিশ্ব মানবতাকে। একটা উদাহরণ: যক্ষ্মা এবং তার চিকিৎসার উপর মুনাফার আধিপত্য। নৃতাত্ত্বিক ক্যাথরিন লাফিড তাঁর ক্যাচিং ব্রেথ: দ্য মেকিং অ্যান্ড আনমেকিং অব টিউবারকিউলোসিস বইতে দেখিয়েছেন, কেন মাইক্রোব্যাক্টিরিয়াম টিউবারকিউলোসিস জীবাণুর মারণক্ষমতা ভয়াবহ। ক্যাথরিনের সঙ্গে সময়ের সরণিতে হাঁটলে আমরা দেখতে পাই, কী ভাবে ধীরে ধীরে যক্ষ্মার জীবাণুরা তাদের শক্তি বাড়াল। প্রথমে সুপ্ত অবস্থায় থাকা যক্ষ্মা সংক্রমণ ছিল শিকারি ও সংগ্রহকারীদের মধ্যে। সভ্যতার বিকাশ, নগরায়ণ ও শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জীবাণুর চরিত্র বদলাল, জাঁকিয়ে বসল সমাজে, শক্তপোক্ত নোঙর ফেলে।

Advertisement

কী ভাবে মাইক্রোব্যাক্টিরিয়াম আর মানুষ এক সঙ্গে বিবর্তিত হল, তা না জানলে প্রতিরোধী যক্ষ্মার (রেজ়িস্ট্যান্ট টিবি) চিকিৎসার সম্ভাব্য সমস্যার উৎসস্থলে পৌঁছনো যাবে না। মাইক্রোব্যাক্টিরিয়াম অনেক ভাবনাচিন্তা করে, সময় নিয়ে মানুষের ফুসফুসকে তার বাসস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতম জীবাণু হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। আমাদের ইমিউন কোষগুলোকে ট্রোজান ঘোড়া হিসেবে ব্যবহার করে তার সমৃদ্ধি ও ব্যাপ্তি বাড়িয়েছে এবং ধূর্ত হয়েছে, যাতে অ্যান্টিবায়োটিক তার কেশাগ্র স্পর্শ না করতে পারে। লন্ডনের মধ্যে আরও এক লন্ডনের খোঁজ দিয়েছেন ক্যাথরিন, যেখানে ফাটল গলে সভ্যতার আলো কখনও-সখনও এসে পড়ে। এই লন্ডন মনে পড়িয়ে দেয় চ্যাপলিনের দ্য কিড (ছবিতে একটি দৃশ্য) সিনেমার পথঘাট, মানুষজন| এরাই আধুনিক লন্ডনের টিবি জীবাণুর আবাসস্থল, যেমন আমাদের দেশে আদিবাসীবহুল খনি এলাকাগুলো, ঘুপচি কারখানা-গহ্বরগুলো। বিজ্ঞানীকে, চিকিৎসককে এখানে জীবাণুর উৎস খুঁজতে হবে মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যে, মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের মধ্যে।

কেন যক্ষ্মার আক্রমণ ২০১৮ সালেও চোখ কপালে তুলে দেয়, সেটা বুঝতে ক্যাথরিন অল্টার-ইভলিউশনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। কিছু প্রশ্ন তুলেছেন লেখক, যেগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। বিসিজি ভ্যাকসিনের কর্মক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলছেন, যেখানে আমরা জানি যে যক্ষ্মা স্বাভাবিক প্রতিরোধী ক্ষমতা (ন্যাচরাল ইমিউনিটি) তৈরি করতে অক্ষম, সেখানে ভ্যাকসিনের ভূমিকা কী? প্রতিরোধী যক্ষ্মাকে চালু বাংলায় বলতে পারি ছ্যাঁচড়া একটা রোগ, এর সৃষ্টিই হয়েছে ওষুধের ভুল ব্যবহার থেকে, বা বলা যায় অপচিকিৎসা থেকে। চিকিৎসা প্রসঙ্গে ক্যাথরিনের মন্তব্য, “যেটা আগেই মরে রয়েছে, তাকে তুমি মারবে কী ভাবে?” জেনেশুনে ভুল প্রযুক্তির উপর আস্থা রাখাটা মূর্খামি না অতি-চালাকি? না কি এক গভীর ষড়যন্ত্র, উন্নয়নের নামে খনি-অরণ্য-নদী এবং মানুষকেই লোপাট করে দেওয়ার জন্য? মানুষের যুগ যুগ ধরে আহরিত জ্ঞান, যে জ্ঞানে সে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে, সমঝোতা করে, তার সেই প্রজ্ঞাকে বিস্মরণে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য?

Advertisement

মাইক্রোবায়োলজিস্ট আলেকজ়ান্ডার টমাস সাবধান করে দিয়েছেন, আমরা একটা দুঃস্বপ্নের সামনে দাঁড়িয়ে, যা কিনা ঘড়িকে অ্যান্টিবায়োটিক যুগের পূর্ববর্তী সময়ে পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তা হলে কেন যুক্তির গলা টিপে বিজ্ঞানের সাধনা, ‘আধুনিকতা’র বহ্নিতে ঝাঁপ দেওয়া? একটাই উত্তর: মুনাফা। যে মুনাফার টান কঙ্গোর মানুষকে ঊনমানব বানিয়ে রাখে, যে প্ররোচনায় ভারতবর্ষের আদিবাসী, রাশিয়ার কাজ হারা শ্রমিক, পেরুর ঘিঞ্জি কলোনির বাসিন্দার জীবন অবিশ্বাস্য সংক্ষিপ্ত, বিশ্বজোড়া ক্রমবর্ধমান গড় আয়ুষ্কালের বিপরীতে তাঁদের গড় আয়ু নেমে চলেছে, সেই টানই প্রভাবিত করে গবেষণা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানকে। দরিদ্র, অসহায়দের যেমন নেই খাবারের, বাসস্থানের নিশ্চয়তা, তেমনই নেই চিকিৎসার বন্দোবস্ত। উল্টে, তাঁদের অসুখটাকে তাঁদের কৃতকর্মের ফল বলে প্রচার চলে, ভারতে টিবির কথা উঠলেই মদের প্রসঙ্গ, সিয়েরা লিয়নে ইবোলার কথায় শিকার করা প্রাণিমাংস খাওয়ার দোষ, আফ্রিকা বা হাইতিতে এডস রোগ আসলে সেখানকার লোকেদের অনৈতিক যৌনাচরণের ফল, ইত্যাদি। রোগের কারণ জীবাণু, এই সত্যটা বারংবার এবং সরবে জানানো হয়। কিন্তু জীবাণুর উৎপত্তির কারণটা কী? মদ, শিকার, যৌনাচারের পিছনের দীর্ঘ অমানবিক ইতিহাসটা কেমন? সেটা জানা এবং জানানো দুটোই বিপজ্জনক। এক কবির কথায়, “মনসার পূজা ঢের বেশি ভাল, কে চায় পুজিতে জ্যান্ত সাপ?”

(শেষ)

সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন