তা হারে চোখে দেখি নাই, কেবল গল্প করিয়াছি সোশ্যাল মিডিয়ায়, হৃদ্যতা করিয়াছি ভার্চুয়াল স্পেসে। কেবল বন্ধুত্ব বা প্রেম কেন, বহু কিছুই চাক্ষুষ দেখিবার আকাঙ্ক্ষা তেমন আর নাই। কারণ আমার নিকট স্মার্টফোন রহিয়াছে।— আই-জেনারেশন, অর্থাৎ কিশোর বা নবতরুণ প্রজন্মের মনের কথা এবং আচরণ যেন ইহাই বলিতেছে। অন্তত এমন একটি ধারণা প্রকাশ্যে আনিয়াছে আমেরিকার স্যান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা। ১৯৯৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জাত এক কোটি দশ লক্ষ ছেলেমেয়ের উপর কৃত অনেকগুলি সমীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করিয়া গবেষকদের সিদ্ধান্ত: এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মুখোমুখি সাক্ষাৎ বা আলাপ করিবার, এমনকী অভিসারে যাইবার অপেক্ষাও নিজস্ব স্মার্টফোনের সহিত অনেক বেশি সময় কাটাইতে ভালবাসে। যুগ বদলাইয়াছে, পছন্দও বদলাইয়াছে। প্রযুক্তি দখল করিয়া লইয়াছে জীবন-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। এই সমীক্ষায় তাহারই পরিচয়।
এই পরিবর্তন লইয়া উদ্বেগ কেন? কেহ যদি স্মার্টফোনে তাহার জীবনের পছন্দের বিষয়, পছন্দের গান, পছন্দের পড়াশুনা, পছন্দের আলাপ এবং পছন্দের প্রেম খুঁজিয়া লইতে পারে, তাহা হইলে সেই যন্ত্রে ধৃত মহাজগতে মগ্ন থাকিলে দোষ কোথায়? কেবল এই কারণে যে, তাহা বহুকালের প্রচলিত রীতিকে অস্বীকার করে? কিন্তু পরিবর্তন তো জীবনের ধর্ম! এই প্রজন্মের কেহ যদি প্রশ্ন করেন, কাহারও সহিত অভিসারে যাইবার পূর্বে তাঁহার মনোভাব, তাঁহার পছন্দ সম্পর্কে কিয়ৎ অবগত হইতে পারিলে ক্ষতি কী? পাঁচ জনের সঙ্গে দেখা করিয়া হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবার চাহিতে এই ব্যবস্থা তো শ্রেয়। ইহাতে কেবল ভুল অভিসারে যাইবার ঝুঁকি কমে না, পছন্দসই বিষয়ে সময় কাটাইবার সময় বাড়ে। আর মানুষের সহিত সংযোগ? স্মার্টফোনের প্রযুক্তি নিমেষে তাহা সম্পাদনে সক্ষম। কথা বলা বা বার্তা পাঠানোই নহে, এখন কথা বলিবার সময় অন্য প্রান্তের মানুষটিকে দেখা অবধি যায়। সুতরাং, প্রযুক্তি কেন বাধ্যতে!
কিন্তু বিষয়টিকে শুধুমাত্র যুক্তি ও প্রযুক্তি দ্বারা নহে, মন দিয়া, মনন দিয়া বিচার করা দরকার। অতীতে দূরবর্তী মানুষের সহিত তাৎক্ষণিক সংযোগ অসম্ভব ছিল, ফলে মানুষের সহিত মিলিবার আকুলতাও ছিল। মেঘদূতের মন্দাক্রান্তা ছন্দে সেই আকুলতারই আশ্চর্য প্রকাশ। প্রযুক্তি, বিশেষত গত এক দশকে, এই সংযোগকে অতি সহজ করিয়া তুলিয়াছে। তাহার ফলে মানুষে মানুষে সম্মুখসংযোগ দ্রুত কমিতেছে। কিন্তু এক জন মানুষকে সম্মুখ হইতে না দেখিলে কি জানা যায়— তাহার ভাবভঙ্গি মোহময় না কর্কশ, উদাসীন না নির্মম? তাহার দাপট অথবা অসহায়তা কি এক মিনিটের ভিডিয়ো কল-এ অনুভব করা সম্ভব? কাহাকেও সামনাসামনি দেখিয়া মুগ্ধ হওয়া বা তাহার দুর্দশায় প্রাণ কাঁদিয়া উঠিবার বিকল্প এখনও স্মার্টফোন তৈয়ারি করিতে পারে নাই। তাহার ফলেই, মানুষ মানুষের সংস্পর্শে আসে না বলিয়াই, হয়তো মানবিকতার কিছু বোধ মনুষ্যপ্রজাতির মধ্যে কমিয়া যাইতেছে। বিচ্ছিন্নতার নীল-তিমিরা আই-জেনারেশনকে গ্রাস করিয়া লইতেছে। এই বিচ্ছিন্নতাই হয়তো প্রযুক্তিধন্য নূতন প্রজন্মের স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ। নিয়তি কেন বাধ্যতে?