কাকে বলে সুখ? আন্তর্জাতিক সুখদিবসে কিছু জরুরি ভাবনা

সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে সুখের। এ বিষয়ে প্রাচীন ভারত তথা প্রাচীন বিশ্বের ভাবনা এখন কার্যত গ্রন্থাগারে বন্দি। লিখছেন সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায়যে মাপকাঠিতে এই সুখী হওয়ার বিচার করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, উপার্জন, ক্ষমতা, স্বাধীনতা, দাক্ষিণ্য, সততা, সুশাসন ইত্যাদি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯ ১০:০৩
Share:

আজ, ২০ মার্চ তারিখটিকে ‘বিশ্ব সুখদিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো বলছে— ‘টেক টাইম টু মেক ইয়োর সোল হ্যাপি’। বিশ্বের ১৫৬টি দেশের মধ্যে সুখী হওয়ার তারতম্যে ভারত একটু পিছিয়ে ১২২তম স্থান থেকে ১৩৩তম স্থানে চলে এসেছে। সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির তুলনায় শেষ দিকে। পাকিস্তানের মতো দেশও ৭৫তম স্থানে রয়েছে।

Advertisement

যে মাপকাঠিতে এই সুখী হওয়ার বিচার করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, উপার্জন, ক্ষমতা, স্বাধীনতা, দাক্ষিণ্য, সততা, সুশাসন ইত্যাদি। সুখী দেশ হিসেবে প্রথম স্থানটি দখলে রয়েছে ফিনল্যান্ডের। তার পর যথাক্রমে নরওয়ে, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইজ়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া। ২০০৭ সালে আমেরিকা তৃতীয় স্থানে থাকলেও তারা এখন ১৮তম স্থানে চলে এসেছে। তার পরেই আছে ব্রিটেন।

এ বছরের থিম হল ‘হ্যাপিয়ার টুগেদার’। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সুখে শান্তিতে থাকুক, তা প্রাচীন ভারত কামনা করত। ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদে আছে— ‘সর্বে ভবন্তু সুখিন/ সর্বে সন্তু নিরামায়াঃ/ সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু/ মা কশ্চিদ দুঃখমাপ্নুয়াত/ ওম্ শান্তি শান্তি শান্তি’। অর্থাৎ, সবাই যেন সুখী হয়, সকলের যেন নিরাময় হয়, সকল মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক, কস্মিনকালেও যেন কেহ দুঃখবোধ না করেন। সকলে শান্তি লাভ করুন (১/৪/১৪)।

Advertisement

প্রাচীন ভারতের সেই ভাবনা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আর ভোগবাদী ভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। আমাদের যে ব্যক্তিগত জীবন, সেই জীবনে ‘সবাই তো সুখী হতে চায়/ কেউ সুখী হয় কেউ হয় না’। মনের মধ্যে অবিরাম পাক খেতে থাকে— ‘সুখের কথা বোলো না আর/ বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি’। অবিরাম অন্তহীন সুখের অন্বেষণে ছুটে চলাই আধুনিক জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আনন্দ ও শান্তির তোয়াক্কা না করে দৈহিক ও মানসিক সুখের জন্য দৌড়ই। এক সময় জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে হয় ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল/ অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলই গরল ভেল’।

ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্যগ্রহণের সুখ আর প্রকৃতি প্রেমিকের সমুদ্রদর্শনের সুখ কখনওই এক নয়। দার্শনিক বেন্থাম ও মিলের ভাবনার মধ্যে যে পার্থক্য, তা এখানেও স্পষ্ট। প্রকৃত সুখের অন্বেষণে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা এক সত্য থেকে আরও গভীরতর সত্যের প্রতি অগ্রসর হই।

প্রকৃত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ শিক্ষা লাভ করে। মনুষ্যত্বের গুণগুলি যাতে বিকশিত হয় এবং নিজের অসম্পূর্ণতা গুলিকে দূরে সরিয়ে মানুষ যাতে সম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলে, তারই প্রয়াস চালায়। অথচ, আমরা ভ্রমের বশবর্তী হয়ে, শিক্ষাকে প্রকৃত ভাবে গ্রহণ করতে না পেরে, মনুষ্যত্বের অবমাননা করে চলি। বর্তমানে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোন প্রকারে অর্থ উপার্জন। নিজেকে বাজারের উপযোগী করে তোলাই যেন বিদ্যাশিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, মানুষ চিরদিন কামনা করেছে আদর্শের শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা, বিবেকের জাগরণ, মনুষ্যত্বের জয়গান ইত্যাদিকে। ফুলের সৌরভের মতো ব্যক্তিত্বের মর্যাদাবোধ চিরকাল মানুষকে মোহিত করেছে। ক্ষুদ্র ‘আমি’ থেকে বৃহৎ ‘আমি’র অন্বেষণে মানুষ অগ্রসর হয়েছে। ‘বৃহৎ বদেম বিদথে সুবীরা’— বীরোচিত মহিমায় বলব বৃহতের কথা। এমন বৃহতের সাধনার দ্বারাই আমরা মনুষ্যত্বের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে

পৌঁছতে চেয়েছি। জ্ঞানের যে চোখ আমাদের উদিত হয়, তার সাহায্যেই আমরা সত্যের উপলব্ধি করতে শিখি। জীবনের সারসত্য উপলব্ধি করার সময় আমাদের মনে বিশ্বাস জন্মায়— ‘সুখমিতিবা দুঃখমিতিবা’— অর্থাৎ, সুখই-বা কী আর দুঃখই-বা কী!

ভারতীয় সাহিত্যে ও সমাজে শিবঠাকুর স্বয়ং দুঃখের দেবতা হয়ে কন্ঠে বিষ ধারণ করে নীলকণ্ঠ হন। ‘সকল দুখের প্রদীপ’ জ্বালিয়ে পথ চলা শুরু করেন। বৈষ্ণবীয় আধারে দুঃখের নতুন ব্যাখ্যা শুরু হয়— ‘যেটারে দেখিছ দুঃখ, তাহা সুখ, অতি মাত্রায় সূক্ষ্ম’। যতীন্দ্রনাথ তাই ঘোষণা করেন— ‘মিথ্যা প্রকৃতি মিছে আনন্দ মিথ্যা রঙিন সুখ / সত্য সত্য সহস্রগুণ সত্য জীবনের দুখ’। কবিকঙ্কন মুকুন্দদাস দুঃখসমৃদ্ধ জীবন থেকে কী ভাবে দুঃখকে জয় করে জীবন যাপন করতে হয়, তা ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে তুলে ধরেছেন। অভাবের সংসারের চরম দারিদ্রকে কী ভাবে জয় করে সাবলীল ভাবে জীবন যাপন করতে হয়, তারই মহামন্ত্রের সন্ধান এখানে দিয়ে গিয়েছেন তিনি।

রাজার দুলাল সিদ্ধার্থ রাজভোগ-রাজসুখ অস্বীকার করে জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর রহস্য তথা ‘বোধি’ লাভের জন্য পথে বার হয়েছিলেন। আবার, জীবনানন্দের কবিতায় বিপন্ন বিস্ময়ের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনে তথাকথিত সুখী মানুষটির আত্মহত্যার প্রসঙ্গটিও রয়ে গিয়েছে। ঠিক যেন আধুনিক জীবনে ভোগ্যবস্তু সংগ্রহে ক্লান্ত নিজ মনুষ্যত্বের হত্যাকারী ব্যক্তিমানুষের বেদনার চিত্র উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে।

সুখের অন্বেষণে জীবনের আদর্শের মানদণ্ডটি দিন দিন পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। তাই বোধ হয় দারিদ্র, অশিক্ষা, অসহিষ্ণুতা, দূষণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন, ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের ব্যবহার, জলসঙ্কট, মোবাইল সংক্রান্ত বিকিরণ প্রভৃতি জীবনকে জর্জর করে তুললেও ‘হ্যাপিয়ার টুগেদার’ স্লোগানে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের প্রতিটি মানুষের সুখী হয়ে ওঠার কামনা করছে ‘বিশ্ব সুখদিবস’!

(লেখক গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন