মে দিবস: উত্তরবঙ্গের চা-শ্রমিক আন্দোলন

উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বঞ্চনা, আন্দোলন, প্রতিবাদের সুদীর্ঘ ইতিহাস। মে দিবসে সেই ইতিহাস ফিরে দেখলেন বিদ্যুৎ রাজগুরুউত্তরবঙ্গের কৃষকদের আধিয়ার আন্দোলন কিংবা রেল শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রামের ত্রিবেণীসঙ্গমে পরিণত হয়েছিল। মজুরি বৃদ্ধি-সহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৯ ০৬:২৭
Share:

চা শ্রমিক। ফাইল চিত্র।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস, মহান মে দিবস। দিনটি নিছক ক্যালেন্ডারের দিন নয়। ঐতিহাসিক দিন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শরণ নিয়ে বলা যায়— ‘ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’। শ্রমজীবী মানুষের লড়াই-গাথার সুমহান ইতিহাস সুবিদিত। আন্দোলনই মুক্তির পথ। তা কোনও মন্ত্র দিয়ে হয় না। রক্তস্নাত ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে অধিকার অর্জন করার দিন মে দিবস। দুনিয়ার মজদুর এক হওয়ার স্লোগানে আর উদ্‌যাপনের মধ্যে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি সারা দেশের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্স ও পার্বত্য এলাকার চা-বাগানগুলিতেও পালন করা হয়।

Advertisement

উত্তরবঙ্গের ভূমিরূপের বৈচিত্রে রয়েছে বন্ধুর পার্বত্য উপত্যকা, গভীর গিরিখাদ। পার্বত্য অঞ্চল কৃষিকাজের পক্ষে অনুকূল নয়। বাগিচা ফসল চা-কে কেন্দ্র করে চা-শিল্প এখানে জগৎ বিখ্যাত। তরাই-ডূয়ার্স আর পর্বতের ঢালে চায়ের অপরূপ বাগানগুলির অবস্থান। চা-বাগানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জনবসতি শহর আর ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রত্যেক শিল্প উন্নয়নের পিছনেই থাকে সংগ্রামের ইতিহাস। থাকে শোষণের গা-হিম করা ইতিহাস এবং আন্দোলনের গাথা। আমেরিকার হে মার্কেটের লড়াকু শ্রমজীবী মানুষের কণ্ঠ আজও শোনা যায় চা-বাগানের শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদে আর প্রতিরোধের উপাখ্যানে, তা সে আন্দোলনের ধরন যেমনই হোক না কেন। চায়ের আবিষ্কার চিন, মহাচিন কিংবা অসমের যেখানেই হোক না কেন, শ্রমিকদের প্রতি বঞ্চনা আর শোষণের জাঁতাকলের ইতিহাসটি স্পষ্টই। শ্রমিকশ্রেণি রুটিরুজির প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হয়। আর রাষ্ট্রের চরিত্র অনুযায়ী অবস্থান নেয় শাসকপক্ষ। অবশ্যই মুনাফার পক্ষে। বিভিন্ন শিল্পের মতো চা-শিল্পেরও নানান সম্যসা রয়েছে। সোনার হরিণের লোভ দেখিয়ে ব্রিটিশ অধিকৃত প্রদেশ ও দেশের মানুষদের, বিশেষ করে নেপাল, ছোটনাগপুর, সিংভুমের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আদিবাসীদের অসম, তরাই, ডূয়ার্স ও দার্জিলিং অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। এই ‘মানুষ ধরার দল’ মজুরদের চরম বঞ্চনা আর অবহেলায় ঋণদাস করে রেখেছিল। চা-শিল্পের উষালগ্ন থেকেই তাঁরা ছিলেন অত্যাচারিত। কার্যত বন্দিজীবনই কাটাতে হত তাঁদের। ম্যানেজারেরা ছিলেন সর্বেসর্বা। ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফুঁসছিলেন চা-বাগিচার শ্রমিকেরা। তাঁদের একত্রিত করে পাহাড়ের চা-বাগানগুলিতে লড়াই শুরু করেন রতনলাল ব্রাহ্মণ। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান আর মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। উত্তরের শ্রমিক আন্দোলনে বামপন্থী নেতার ভুমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছে বার বার। তবুও দমার পাত্র ছিলেন না রতনলাল। চা-শ্রমিকদের প্রতিবাদ করার উপায় ছিল না। রতনলাল ব্রাহ্মণের মতো শ্রমিকনেতা শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য তৈরি করেছিলেন। উত্তরবঙ্গের কৃষকদের আধিয়ার আন্দোলন কিংবা রেল শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রামের ত্রিবেণীসঙ্গমে পরিণত হয়েছিল। মজুরি বৃদ্ধি-সহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হয়। মালিকদের কাছে চ্যাটার অফ ডিমান্ড পেশ করা হয়। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে লড়াই করার শক্তি অর্জন করেন চা-শ্রমিকরা। বিভেদকামী শক্তি জাতপাতের রাজনীতি আমদানি করে শ্রমিক ঐক্যে ফাটল ধরাতে উদ্যত হয়। পাহাড় সমতলের ভোট রাজনীতি মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যখন ফাটল ধরায়, দুনিয়ার মজদুর এক হওয়ার সুরটিতে তাল কাটে। তবুও শিক্ষার দিকটি এটাই যে, যে কোনও সাধারণ আন্দোলনের চেয়ে চা-শ্রমিক আন্দোলন অনেক বেশি সংহত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

Advertisement

বৃষ্টিস্নাত দিনে ঢালু উপত্যকা জুড়ে কচি সবুজ দু’টি পাতা আর একটি কুঁড়ি জলজ ফোঁটায় ঝলমল করে। কখনও ছায়া গাছের তলায় শিশুর কোল দুলতে থাকে। তবুও দু’টি পাতা একটি কুঁড়িতে যেন লেপটে থাকে সূচের মতো ব্যথা আর যন্ত্রণার উপাখ্যান। বেলা শেষে ঘরে ফেরার পালা। রক্ত মেঘের টানে ফিরে যায় তাঁদের নিজস্ব ডেরায় শ্রমিক লাইনে। সান্ধ্য আড্ডায় ধামসা মাদলের বোলে লোকগানে মেতে ওঠেন চা-শ্রমিকরা সান্ধ্য অবসরে। তাঁদের জীবনযন্ত্রণার করুণ কাহিনি কিংবা অবসর বিনোদনের আনন্দ অনুভূতির শাশ্বত সুরলহরি টিকিয়ে রেখেছে নিজস্ব সংস্কৃতিতে।

তবুও মনে হয়, সব কিছুই নিমেশে যেন হারিয়ে যাচ্ছে! চা-বাগান লক আউটের রোজকার খবর দেখে প্রায় দিন ঘুম ভাঙে। শ্রমিকদের তাকিয়ে থাকতে হয় মালিকদের মর্জির উপর। যাঁদের খেয়ালে কারখানার গেট খুলবে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারা এগিয়ে আসে ফি বছর আর্থিক কিংবা খাদ্যশস্য দিয়ে সাহায্য করতে। সরকারি স্তরের প্রতিশ্রুতি আর ভুরতুকির সস্তা রাজনীতি চলে। চলে শাসক আর বিরোধী চাপানউতোর। কিন্তু শ্রমিকদদের কিংবা চা শিল্পের মুল সমস্যার গভীরে কেউ যায় না। মে দিবসের পতাকা উত্তোলন কিংবা আমেরিকার হে মার্কেটের লড়াইয়ের কাহিনি গলার রোগ ফুলিয়ে গরম গরম বক্তব্যেই মে দিবসের উদ্‌যাপন শেষ হয়। পরের দিন আবার যে কে সেই। ঠিক শ্রমনীতি প্রণয়ন করা ও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে শ্রমিক-কল্যাণমুখী শিল্প নীতি গ্রহণ অবশ্যই রাষ্ট্রের করা উচিত।

উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অর্থনীতি চা শিল্পের উপর নির্ভরশীল। চা-বাগিচার শ্রমিকদের সন্তান সন্ততিদের বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা ভাবতে হবে। বাগানগুলি যেহেতু অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপে ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে অবস্থান করছে, কাজেই চা-শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠতেই পারে পর্যটন শিল্প, যা নতুন নতুন করে চা শিল্পের শিকড়ে রসদ জোগাবে। উত্তরবঙ্গে হাত ধরাধরি করে বাঁচুক চা পর্যটন শিল্প। রুটিরুজির সংগ্রাম তবেই সফল হবে। মে দিবসের নেতা আলবার্ট পারসনের কথায়, রুটিই স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই রুটি।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন