পোশাক বদলালেও চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসবে কি?

পোশাকের মনস্তত্ত্ব আছে। এক একটি চরিত্র এক একজন যুগনায়ক এক একরকমের পোশাকের দ্বারা পরিচিত হন। গাঁধীজির পোশাককে বাদ দিয়ে আপনি কি গাঁধীকে ভাবতে পারেন? এই যে অর্ধনগ্ন ফকির হিসাবে গাঁধীকে বিদেশি ঐতিহাসিকরাও ব্যাখ্যা করেছেন, সেটিও সম্ভব হয়েছে তাঁর পোশাকের পরিচিতিতে। পোশাক এক একটি ব্র্যান্ড গড়ে তোলে। তৈরি হয় Identity বা পরিচিতি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৬ ০০:০১
Share:

পুরনো পোশাকে আরএসএস। ছবি: রয়টার্স।

পোশাকের মনস্তত্ত্ব আছে। এক একটি চরিত্র এক একজন যুগনায়ক এক একরকমের পোশাকের দ্বারা পরিচিত হন। গাঁধীজির পোশাককে বাদ দিয়ে আপনি কি গাঁধীকে ভাবতে পারেন? এই যে অর্ধনগ্ন ফকির হিসাবে গাঁধীকে বিদেশি ঐতিহাসিকরাও ব্যাখ্যা করেছেন, সেটিও সম্ভব হয়েছে তাঁর পোশাকের পরিচিতিতে। পোশাক এক একটি ব্র্যান্ড গড়ে তোলে। তৈরি হয় Identity বা পরিচিতি। চার্লি চ্যাপলিনের পোশাক, ফিদেল কাস্ত্রোর পোশাক থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাওয়াই চটি। এ সবই তো ব্যান্ড ইক্যুইটি।

Advertisement

আরএসএসের জন্ম হয়েছিল ১৯২৫ সালে। সেই সময় থেকেই ‘স্বয়ংসেবক সংগঠন’ হিসাবে এই পথ চলা। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোনও রাজনৈতিক বা সরকারি সংগঠনও নয়। অনেকটা সাবেকি ব্রতচারী সংগঠন বা স্কুলের এনসিসি-র মতো। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতারা মনে করেন, একটা ইউনিফর্ম বা পোশাক হওয়া প্রয়োজন সংগঠনের সদস্যদের। খাকি হাফপ্যান্টের শুরু সে সময় থেকে। অনেকে বলেন, নাজি বাহিনীর পোশাক অর্থাৎ হিটলারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমনকী মুসোলিনীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এই খাকি রং। স্বস্তিকা চিহ্ন এমনকী গাঁধী টুপি নয়, অন্য ধরনের টুপি এ সবই অনুপ্রবেশ করে আরএসএস সংস্কৃতিতে।

বীর সাভারকরের বিভিন্ন রচনায়-বক্তৃতায় এই হিটলারি জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে সওয়ালও আছে। আরএসএস বিরোধী ভারতীয় প্রতিপক্ষ এ ব্যাপারে তীব্র সমালোচনাও করেছে বহু বার। তবে আমার মনে হয়, অতি সরলীকরণের শিকার না হয়ে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে ইতিহাসকে দেখাই ঔচিত্য। হিটলার তো নীটশের নিহিলিসমের দ্বারা প্রভাবিত হন। তা বলে নীৎসে=হিটলার বলাটা বোধহয় অনুচিত। নীটশের শূন্যবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পথ চলা শুরু করলেও হিটলার এক উগ্র প্যান-জার্মানিজমে উপনীত হন। এক উগ্র জাতীয়তাবাদে তিনি পৌঁছান।

Advertisement

সেই খাকি পোশাকের অবশেষে পরিবর্তন হল। ২০১৬ সালে এই সিদ্ধান্ত হল। আপাতভাবে সামান্য হলেও এ এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। খাকি হাফপ্যান্টের বদলে আসবে ব্রাউন ফুল প্যান্ট। সময় বদলে গিয়েছে। অনুশীলন সমিতি যুগান্তর পর্বেও কুস্তি শেখা, ডাম্বল ভাজা— এ সব ভারতীয় যুবকদের এক মাসকিউলিন সংস্কৃতি ছিল। এখন তো আধুনিক যুবক মেট্রো সেক্সুয়াল। জিমে যায়, ট্রেডমিল করে, শরীর চর্চা হয়, কার্ডিয়াক ও ভারী জিনিসের উত্তোলনও হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আজকের যুবকেরা কানে দুল পড়ে, ফেসিয়াল করে। এই কো-এডুকেশনের যুগে নারী বর্জিত নাটকের মত ব্যাচেলার প্রচারকের জীবন কতটা বাস্তব সম্মত সে প্রশ্নও উঠেছে।

ঠাকুর রামকৃষ্ণ সামাজিক কল্যাণের স্বার্থে গৃহস্থ জীবন ত্যাগ করা এক দল যুবক সন্ন্যাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা আজও সমাজের সম্মানিত অঙ্গ হয়েও সংসার-বিযুক্ত। বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে সাধনা করার বদলে তারা এই ইহ জগতে মানুষের কল্যাণ করবেন এটাই ব্রত। আরএসএসও তেমন কিছু প্রচারকদের মাধ্যমে আজও সংগঠনের সেই নিবেদিত টিমকে বাঁচিয়ে রাখতে আগ্রহী। গেরুয়া পতাকার রঙেও কোনও পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু খাকি হাফপ্যান্ট বদলে গেল নিঃশব্দে।

ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রেও রিপ্যাকেজিং হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পণ্যের পোশাকের রঙ বদলায়। সংবাদপত্রের লে-আউট বদলায়। কোলগেট বা ডাভ সাবানের প্যাকেটের আকৃতি বদলে যায়। তবে পণ্যের ফর্ম বদলালেও কনটেন্ট বদলায়না। আরএসএসের খাকি হাফপ্যান্ট বদলে ফুলপ্যান্ট হলেও আরএসএসের মূল ভাবধারায় কোনও বদল আসছে না। বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী তখনই আরএসএসের কার্যকলাপে আধুনিকীকরণ হচ্ছিল। আরএসএস যুবকদের জন্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ ব্যবহার শুরু হয়। আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা ছিল প্রধান লক্ষ্য। এর ফলে সঙ্ঘের যুবক সংখ্যা বাড়তেও থাকে। আজ এই পোশাক বদলানোর সিদ্ধান্তে তাই যেমন চমক আছে, তেমন ভাবনা চিন্তায় পরিবর্তন আনার এক বার্তা আছে।

সমস্যা হচ্ছে রাম মাধবের মত আরএসএস নেতা এমনকী আডবাণীর মত প্রধান নেতাও আরএসএসের আধুনিকীকরণ চাইলেও তারা ভাবনাচিন্তায় সত্যি সত্যি কতটা পরিবর্তন আনতে পারবেন সেটাই দেখার। যদিও তত্ত্বগত ভাবে মন্দিরে নারীর প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞা জারির বিপক্ষে মত জানিয়েছেন তারা, কিন্তু বাস্তবে মেয়েদের সম্পর্কে তাদের সত্যিকারের মনোভাব কী? আরএসএসের কোনও নিজস্ব মহিলা সংগঠন কোথায়? বরং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নারী সংগঠন তৈরি করে সমাজের এই চাপকে একদা মেনে নিয়েছিলেন সঙ্ঘের নেতারা কিন্তু আজও আরএসএস পুরুষ পরিচালিত ও শাসিত সংগঠন। তত্ত্বগত ভাবে আরএসএস দলিত বিরোধী নয়, বরং হিন্দু ধর্মের ঐক্যকে সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মিলনই তো প্রয়োজন। তা না হলে বহুজন সমাজ পার্টির মত দলই তো শক্তিশালী হয়। কিন্তু বাস্তবে তা কী হচ্ছে?

বরং নাগপুরের সঙ্ঘের প্রধান পুরুষরা তো সবাই ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি। দলিত বিচ্ছিন্নতার জন্য ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র দায়ী এ কথা কি আরএসএস মানতে পারে? মনুস্মৃতির নেতিবাচক দিকগুলি সম্পর্কে আরএসএস কি প্রকাশ্যে সোচ্চার হবে এ বার?

ভারতীয় মুসলমান এবং ইসলাম সম্পর্কে ও আরএসএসের মনোভাব তত্ত্বগতভাবে নেতিবাচক নয়, কিন্তু বাস্তব চিত্র কী? বাস্তবে তো শুধু ইসলাম নয়, খ্রীস্ট, বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য পর্যন্ত হিন্দুবাদীরা মানতে রাজি নন। তাই তারা রাজা শশাঙ্কের বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে লড়াইকে পছন্দ করলেও ভিতরে ভিতরে সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ হয়ে যাওয়াকে অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেন না।

খাকি প্যান্ট বদলালে তাই আরএসএস মন কি বদলাবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন