এক একটি সময় আসে যখন নবীন প্রজন্মের কাছে হাঁটু মুড়িয়া বসিয়া আবার নূতন করিয়া মূল্যবোধ শিখিতে হয়। মার্কিন দেশের এমা গনজালভেস নামের ফ্লরিডার স্কুল-ছাত্রীটি তেমনই একটি অভিজ্ঞতার শামিল করিয়া দিলেন। বুঝাইয়া দিলেন, ‘যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হইতে উচ্ছ্বসিয়া ওঠে’, সেই অভিমুখে যাত্রা করিতে হইলে এখন তাঁহার মতো নব্যযৌবনপ্রাপ্তরাই একমাত্র ভরসা। নতুবা মার্কিন রাজনীতিক মহলের পক্ষে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মুখের উপর এত কঠিন ভর্ৎসনা করিবার সাহস জোগাড় করা মোটেই সহজ বা সুলভ নহে। কে না জানে, রাজনৈতিক স্বার্থ সব দেশে সব ক্ষেত্রেই বহুধাবিহারী। অপরাধের প্রতিবাদ করিতে রাজনৈতিক স্বার্থ মোটেই সাহায্য করে না, বিভিন্ন ভাবে বাধা দেয়। সুতরাং অপরাধের প্রতিবাদের আজও যেটুকু আশা, তাহাকে আসিতে হইবে এমন জায়গা হইতে যেখানে রাজনৈতিক স্বার্থ এখনও পূর্ণ ভাবে বিকাশ করে নাই। অর্থাৎ অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের নিকট হইতে। ‘বড়রা’ যে-ভাবে ভাবেন না, এই ছেলেমেয়েরা সেই ভাবে ভাবিবেন, এবং বড়দের নিকট মূর্তিমান ভর্ৎসনার প্রতিরূপ হইয়া উঠিবেন, চার দিকের দুরাচারগ্রস্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবহে ইহাই এখন একমাত্র আশা। এমা নামে এই সুবাগ্মী সাহসী মেয়েটি সেই আশার আলোটি উসকাইয়া দিলেন।
এমা কেবল চুলমাত্র দূরত্বে নিজে মৃত্যু হইতে বাঁচিয়া গিয়াছেন। স্কুলের আপাদ-নিরাপদ চত্বরে ১৭ জন পরিচিতকে চোখের সামনে চিরতরে হারাইয়া ফেলিয়াছেন। তাঁহার চোখের জলে কেবল যন্ত্রণা নয়, উষ্মা ও ঘৃণার স্রোত বহিয়াছে। সার কথাটি তিনি প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে বলিয়া দিয়াছেন যে, প্রেসিডেন্ট যতই অপরাধী ছেলেটিকে ‘মানসিক ভাবে অসুস্থ’ বলিয়া বিষয়টি লঘু করিয়া ঝাড়িয়া ফেলিতে চাহেন না কেন, সমস্যার মূলটি কখনওই মানসিক অসুস্থতার মধ্যে নাই, আছে বন্দুকের সহজলভ্যতার মধ্যে। এমা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন, মানসিক ভাবে অসুস্থ ছাত্রটি যদি হাতে ছুরি লইয়া বিদ্যালয়ে আসিয়া তাণ্ডব করিত, এত সংখ্যক মানুষকে সে জীবন হইতে বরবাদ করিয়া দিতে পারিত না। একটি সত্য সহজ এবং স্পষ্ট। বন্দুকই এই মর্মান্তিক ঘটনা সম্ভব করিয়াছে।
এবং ট্রাম্পের মতো নেতারাই বন্দুকের এই অবিশ্বাস্য সহজলভ্যতা সম্ভব করিয়াছেন। প্রসঙ্গত নির্বাচনে লড়িবার সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোটি কোটি ডলার অর্থসাহায্য লাভ করিয়াছিলেন ন্যাশনাল রাইফ্ল অ্যাসোসিয়েশন-এর কাছ হইতে, এমনই রটনা। বন্দুক-লবির এত বড় ‘সমর্থক’ যে নেতারা, যাঁহাদের ভোটে জিতাইবার কান্ডারি হিসাবে বন্দুক লবি এত গুরুত্বপূর্ণ, তাঁহারা কেনই বা বন্দুক বিষয়ে কঠোর অবস্থান লইবেন, কেনই বা সাধারণ নাগরিকের দিক হইতে সমস্যাটিকে দেখিবেন? ফ্লরিডার মতো প্রদেশে বন্দুক কেনা সিগারেট কেনার অপেক্ষা অনেক গুণ সহজ, বন্দুকের কোনও রেজিস্ট্রেশনও দরকার হয় না, সুতরাং মানসিক ভাবে অসুস্থও যে কোনও দিন একাধিক বন্দুক জোগাড় করিয়া ফেলিতে পারেন, কিছু লোককে মারিয়া চিত্তবিনোদনের ইচ্ছা প্রকাশ্যে প্রকাশ করিতে পারেন। একের পর এক স্কুলের ঘটনায় এই ভাবে নানা মানসিক ভারসাম্যহীন পড়ুয়ার বন্দুকতাণ্ডবে যাহাদের প্রাণ যাইতেছে, তাহাদের হইয়া দুই কথা বলিবার মতো কোনও নেতাকে তাই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বড়দের পৃথিবীতে তাই এগুলি ‘হইতেই থাকে’, কখনও নিস্পৃহ দূরত্বে কখনও হতাশ অসহায়তায় বড়রা নীরব থাকেন। এমা মনে করাইয়া দিলেন, এই নীরবতা স্বাভাবিক নয়। প্রয়োজনে বড়দের শূন্যস্থান পূর্ণ করিবার জন্য তাঁহারা নীরবতা ভাঙিতে পারেন।