দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, জ্বালানি থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা। দু’দিনের সফরে নয়াদিল্লির সঙ্গে একগুচ্ছ চুক্তি সেরেছেন ভারতের ‘বন্ধু’ ভ্লাদিমির পুতিন। যদিও এ সব কিছুকে ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সমঝোতা। সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত শক্ত করতে এ দেশের নৌসেনাকে একটি ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ উপহার দিতে চাইছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। অত্যাধুনিক হাতিয়ারটি জলযোদ্ধাদের অস্ত্রাগারে শামিল হলে চিন-পাকিস্তানের যে রাতের ঘুম উড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, পুতিনের ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’টি হল ‘৩এম-১৪ই ক্যালিবার’ ভূমিতে হামলাকারী (পড়ুন ল্যান্ড অ্যাটাক) ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। এর সাহায্যে সমুদ্র থেকে যে কোনও শত্রু দেশের উপকূলভাগের ১,৫০০ কিলোমিটারের ভিতরে আক্রমণ শানাতে পারবে ভারতীয় নৌবাহিনী। এ দেশের ডুবোজাহাজগুলির নকশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি মানানসই বলে দাবি করেছে মস্কো। আর তাই ক্ষেপণাস্ত্রটির ব্যাপারে নয়াদিল্লির সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা সেরেছে তারা।
রুশ ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রটির একটি রফতানি ভার্সান রয়েছে। তার নাম ‘৩এম-১৪ই ক্যালিবার-পিএল’। মস্কোর প্রস্তাব মেনে নিলে সংশ্লিষ্ট ‘ব্রহ্মাস্ত্র’টি হাতে পাবে ভারতীয় নৌসেনা। এ দেশের ডুবোজাহাজগুলিতে রয়েছে ৫৩৩ মিলিমিটারের টর্পোডে টিউব। এগুলিকে এক ধরনের লঞ্চার বলা যেতে পারে। ক্রেমলিনের দাবি, তাদের ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ওই টিউবের মাধ্যমে ছুড়তে পারবে এ দেশের নৌবাহিনী।
চলতি বছরের গোড়ার দিকে মস্কো সফর করেন এ দেশের নৌবাহিনীর পদস্থ কর্তারা। তখনই সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির ব্যাপারে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত মধ্যস্থতাকারী রাষ্ট্রায়ত্ত রুশ সংস্থা ‘রোসোবোরোনেক্সপোর্ট’-এর সঙ্গে একপ্রস্ত কথা হয় তাঁদের। সংশ্লিষ্ট বৈঠকে হাজির ছিলেন ‘৩এম-১৪ই ক্যালিবারের’ নির্মাণকারী সংস্থা ‘নোভাটর ডিজ়াইল ব্যুরো’র আধিকারিকেরাও। যদিও সেখানে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, ক্যালিবার পরিবারের রুশ ল্যান্ড অ্যাটাক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কোনও একটি হাতিয়ার নয়। বরং একে পরিপূর্ণ মডিউলার সিস্টেম বলা যেতে পারে। নকশায় কোনও রকম পরিবর্তন ছাড়াই সংশ্লিষ্ট ‘ব্রহ্মাস্ত্র’টির ডুবোজাহাজের চরিত্র বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। এগুলির সংশ্লিষ্টকরণে সমুদ্রের গভীরে থাকা ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ যে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
১৯৯৪ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ব্যবহার করছে রুশ নৌবাহিনী। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে ইউক্রেনের লড়াই, নিজের ক্ষমতা দেখিয়েছে ‘৩এম-১৪ই ক্যালিবার’। হাতিয়ারটির একাধিক শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। আর তাই এর ওজন ১,৩০০-২,৩০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। ৬.২ থেকে ৮.৯ মিটার লম্বা ক্ষেপণাস্ত্রটি ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি বিস্ফোরক নিয়ে নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম। হামলার সময় সর্বোচ্চ শব্দের চেয়ে তিন গুণ গতিতে (পড়ুন ৩ ম্যাক) ছুটতে পারে পুতিনের এই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’।
মস্কোর ক্যালিবার পরিবারের ভূমিতে হামলাকারী এই ক্ষেপণাস্ত্রটির তিনটি সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, ডুবোজাহাজ ছাড়া ডেস্ট্রয়ার বা ফ্রিগেট শ্রেণির রণতরী থেকে এর মাধ্যমে হামলা করতে পারবে ভারতীয় নৌসেনা। দ্বিতীয়ত, গতির কারণে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) সাহায্যে একে চিহ্নিত করে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করা বেশ কঠিন। তৃতীয়ত, প্রথাগত বিস্ফোরকের পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্রও বহনে সক্ষম রুশ ‘৩এম-১৪ই ক্যালিবার’।
এ-হেন ‘ব্রহ্মাস্ত্রের’ প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে দিল্লি-মস্কো কথাবার্তা কত দূর এগিয়েছে, তা নিয়ে মুখ খুলেছেন ভারতীয় নৌবাহিনীর এক পদস্থ কর্তা। এ বছরের গোড়ায় হওয়া রুশ সফরে ছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আধিকারিক। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের জন্য ক্যালিবার-পিএল একটা মেগা অফার। এর সাহায্যে সামুদ্রিক লড়াইয়ের ফাঁকফোকরগুলো ঢেকে ফেলা যাবে। আর তাই সব স্তর থেকে সবুজ সঙ্কেত মিলবে বলে আমরা আশাবাদী।’’
দীর্ঘ দিন ধরেই ডুবোজাহাজ থেকে হামলাকারী ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র বা এসএলসিএম (সাবমেরিন লঞ্চড ক্রুজ় মিসাইল) তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ নির্মাণের ‘প্রজেক্ট-৭৫ আলফা’র আওতায় চলছে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নৌবাহিনী সূত্রে খবর, গোটা বিষয়টি শেষ হতে চার থেকে ছ’বছর সময় লাগতে পারে। সেই কারণে ‘৩এম-১৪ই ক্যালিবার’ আমদানিতে জোর দিয়েছে তারা।
বর্তমানে ভারতীয় নৌবাহিনীর বহরে বেশ কয়েকটি কিলো এবং স্করপিয়ান শ্রেণির ডিজ়েল-ইলেকট্রিক চালিত ডুবোজাহাজ রয়েছে। মস্কোর হাতিয়ারটি এলে ওই ‘নিঃশব্দ ঘাতক’গুলিকে এর সাহায্যে নতুন করে সাজিয়ে তুলবে তারা। এ দেশের অধিকাংশ রণতরীতে রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। আর তাই শত্রুর উপকূলভাগকে ধ্বংস করতে একই রকম ক্ষেপণাস্ত্র ডুবোজাহাজের বহরেও রাখতে চাইছে নৌসেনা।
নৌবাহিনী সূত্রে খবর, কিলো শ্রেণির ডুবোজাহাজগুলি যথেষ্ট বুড়ো হয়ে গিয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ ধীরে ধীরে সেগুলিকে অবসরে পাঠাবেন তারা। তত দিনে অবশ্য হাতে চলে আসবে পরমাণু শক্তিচালিত বেশ কয়েকটি ‘নিঃশব্দ ঘাতক’। এই পরিস্থিতিতে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে রুশ নির্মিত ‘৩এম-১৪ই ক্যালিবার’ ক্ষেপণাস্ত্রটির প্রয়োজনীয়তার কথা সাবেক সেনাকর্তাদের বলতে শোনা গিয়েছে। এতে পরমাণু প্রত্যাঘাতের শক্তিও বৃদ্ধি পাবে ভারতের।
বর্তমানে পারস্য উপসাগর থেকে মলাক্কা প্রণালী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে ভারতীয় নৌসেনা। এ দেশের জলযোদ্ধাদের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার অন্যতম বড় ‘খেলোয়াড়’ বলে মনে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো দুনিয়ার ‘সুপার পাওয়ার’ দেশগুলি। যদিও সমুদ্রে নয়াদিল্লির শক্তিবৃদ্ধিকে একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না চিন। আর তাই বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরীয় এলাকায় ‘দৌরাত্ম্য’ বাড়িয়েছে ড্রাগনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনা।
নৌসেনার পদস্থ কর্তারা মনে করেন, রাশিয়ার সঙ্গে ‘ক্যালিবার’ ক্ষেপণাস্ত্রের চুক্তি যথেষ্ট কম-ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁদের যুক্তি, সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিকে বর্তমানে বাহিনীর বহরে থাকা বুড়ো হতে চলা ডুবোজাহাজে যেমন ব্যবহার করা যাবে, তেমন আগামী দিনে একে নিয়ে হামলা চালাতে পারবে নতুন প্রজন্মের পরমাণু ‘নিঃশব্দ ঘাতক’। সেই কারণেই উত্তর আরব সাগরে পাক উপকূলের কাছে ‘৩এম-১৪ই ক্যালিবার’কে মোতায়েন রাখতে চাইছেন তাঁরা।
অন্য দিকে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে এসএলসিএম (সাবমেরিন লঞ্চড ক্রুজ় মিসাইল) রুশ প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘এনপিও মাশিনোস্ট্রোয়েনিয়া’র সাহায্য নিয়েছে ডিআরডিও। এ প্রসঙ্গে নৌবাহিনীর এক আধিকারিক বলেছেন, ‘‘ক্যালিবার ক্ষেপণাস্ত্র আমাদের নির্মীয়মাণ হাতিয়ারের বদলি নয়। বরং একে মিসিং লিঙ্ক বলা যেতে পারে। কারণ দিনের শেষে ঘরের মাটিতে তৈরি অস্ত্রের উপরেই আপনাকে ভরসা রাখতে হবে। কিন্তু সেটা তৈরির সময়ে জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলা যায় না।’’
এই আবহে ডুবোজাহাজ তৈরির ‘প্রজেক্ট ৭৫আই’ প্রকল্পের বরাত দিতে ইতিমধ্যেই বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সেখানে নৌবাহিনী কী ধরনের টর্পেডো টিউব চাইছে, পরিষ্কার ভাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৭ সালের মধ্যে আরও তিনটি স্করপিয়ন শ্রেণির ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ হাতে পেতে পারে এ দেশের জলযোদ্ধারা। ‘বন্ধু’ পুতিন তার আগেই নয়াদিল্লিকে ‘ক্যালিবার’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের নির্দেশ দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ৪-৫ ডিসেম্বর ভারত সফরে আসেন রুশ প্রেসিডেন্ট। নয়াদিল্লির পালামে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রোটোকল ভেঙে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে পুতিনকে আলিঙ্গন করেন তিনি। এর পর একই গাড়িতে নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে রওনা হন দুই রাষ্ট্রনেতা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, নয়াদিল্লিতে ক্রেমলিন-কর্তার পা পড়ার আগেই দুই দেশের মধ্যে হওয়া সামরিক সমঝোতায় সবুজ সঙ্কেত দেয় মস্কোর পার্লামেন্ট ‘ফেডারেল অ্যাসেম্বলি’র নিম্নকক্ষ স্টেট ডুমা।
ভারত-রুশ সামরিক চুক্তিটির পোশাকি নাম ‘রেসিপ্রোকাল এক্সচেঞ্জ অফ লজিস্টিক সাপোর্ট’ বা রেলস। সংশ্লিষ্ট সমঝোতা অনুযায়ী, মস্কোর সৈন্যঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি পাচ্ছে নয়াদিল্লি। সেখানে রণতরী, ডুবোজাহাজ এবং লড়াকু জেট মোতায়েন করতে পারবে এ দেশের বাহিনী। পাশাপাশি, মিলবে লজিস্টিক সহায়তাও। অর্থাৎ জ্বালানি, হাতিয়ার, গোলা-বারুদ, রসদ বা যুদ্ধজাহাজ ও জেটের মেরামতি-সহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও ক্রেমলিনের ছাউনিগুলি থেকে নিতে পারবে ভারতীয় ফৌজ।
দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে পুতিনের উপস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে মোট ১৬টি সমঝোতায় সই করে মোদী সরকার। তার মধ্যে রয়েছে মহাকাশ গবেষণা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে শুরু করে কৃষি, বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষাও। তবে শেষের বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে সে ভাবে বিবৃতি দেয়নি দু’পক্ষ। নেপথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কাটসা’ (কাউন্টারিং আমেরিকাজ় অ্যাডভারসারিস থ্রু স্যাংসনস অ্যাক্ট) নিষেধাজ্ঞার ভয়? জবাব খুঁজছে কূটনৈতিক মহল।