আনন্দপাঠ না ভাবের ঘরে চুরি?

পড়তে বললেই পালাতে চায় শিশুরা। স্কুলের নিচু ক্লাসে যা শেখানো হয়, পরীক্ষা যেমন নেওয়া হয়, হেসে-খেলে নেচে-গেয়ে শিশুসন্তান তা শিখছে, এমন ভাগ্যবান বাপ-মা চোখে পড়ে না। নারাজ শিশু, নাছোড় অভিভাবক-শিক্ষক— শিশুশিক্ষার এই হল চেনা নকশা।

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share:

আপ পেয়ারসে পড়াইয়ে।’ হাতজোড় করে বলছে খুদে শিশু। ভিডিয়োটা দেখে সবাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। অতটুকু বাচ্চার সঙ্গে কেউ অমন করে? ওই মহিলার উচিত কাউন্সেলিং করানো। মহিলার মুখটি দেখা যাচ্ছিল না ভিডিয়োতে। ভালই হয়েছে। তাঁর জায়গায় আমরা যে কেউ বসে যেতে পারি। আদর করে, বুঝিয়ে বলার পরেও কার্টুন ছেড়ে হোমওয়ার্ক করতে না-চাওয়া সন্তানকে দু’ঘা কে দিইনি? কে ধমক দিইনি জোরে, যাতে ভয়ে সিঁটকে গিয়ে কথা শুনতে বাধ্য হয় শিশু?

Advertisement

পড়তে বললেই পালাতে চায় শিশুরা। স্কুলের নিচু ক্লাসে যা শেখানো হয়, পরীক্ষা যেমন নেওয়া হয়, হেসে-খেলে নেচে-গেয়ে শিশুসন্তান তা শিখছে, এমন ভাগ্যবান বাপ-মা চোখে পড়ে না। নারাজ শিশু, নাছোড় অভিভাবক-শিক্ষক— শিশুশিক্ষার এই হল চেনা নকশা। মফস্সল বা গ্রামে এ নিয়ে তেমন রাখঢাক কোনও দিনই ছিল না। বাবা-কাকারা শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলতেন, ‘মাস্টারমশাই, মাংস আপনার, হাড়গুলো আমার।’ মানে হাড়টা খালি ভাঙবেন না। হাড় ভাঙেনি, কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি কাকে বলে পড়াশোনা।

এই অভিভাবক, শিক্ষকেরা সবাই কি নির্বোধ, নিষ্ঠুর? যে সন্তানকে পাওয়ার জন্য ডাক্তার-বদ্যি-মন্দির-মাজারে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছি, যে সন্তান জন্মানোর পরে আনন্দে কেঁদে ফেলেছি, ঘুমন্ত বুকে হাত রেখে নিশ্চিত হতে চেয়েছি শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কি না, তাকে মারধর করে কি আমরা আনন্দ পাই? পাই না। কিন্তু সে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখে, বই নিয়ে না বসে, বার বার বলার পরেও মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে? ভালবেসে, বুঝিয়ে বলার পরেও ব্লু হোয়েল-এর মতো বিপজ্জনক খেলা খেলে? যদি বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়ে বিপথে যায়, অকারণে তর্ক করে, কথা না শোনে? তা হলে কী করব?

Advertisement

এখন ‘আনন্দময় শিক্ষা’-র যে জয়গান শোনা যাচ্ছে, মনে মনে অধিকাংশ বাবা-মা জানেন তা আসলে ভাবের ঘরে চুরি। ধরে নিন স্কুল সত্যিই আনন্দনিকেতন হয়ে গেল, বাড়িতেও ভালবাসা আর ভালবাসা। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ বলে ছেলেমেয়েরা বড় হল। কিন্তু তাতে সে যেটুকু শিখল, যা নম্বর জুটল, তাতে হতাশ হয়ে যদি সে নিজেই উল্টে অভিভাবকের উপর হিংস্র হয়ে ওঠে? নম্বর-সর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থায় পিছু হঠে গিয়ে রাখালের মতো সে-ও যদি এক দিন কান কামড়ে জানতে চায়, ‘শাসন করোনি কেন?’

সন্তানপালনে ব্যর্থতার আশঙ্কা সব বাবা-মাকেই তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই শুধু ভালবাসার বুলিতে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন না তাঁরা। অবশ্যই এমনও কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নিজের উচ্চাশাকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দিতে চান। ‘তারে জমিন পর’ ছবির শিশু ঈশানের বাবা তেমন এক চরিত্র, সন্তান হেরে গেলে যিনি নির্মম হয়ে ওঠেন। কিন্তু যাঁরা সাফল্যকেই ভালবাসার শর্ত করেন, কিংবা যাঁরা নির্যাতন করে বিকৃত আনন্দ পান, শুধু তাঁদের দিয়েই শাসনের প্রয়োজন বুঝলে ভুল হবে। সন্তানের কল্যাণ যাঁদের কাছে অগ্রগণ্য, তাঁদেরও অনেকে সন্তানকে জোর করতে বাধ্য হন।

দরিদ্র অভিভাবকের কাছে সন্তানের প্রতি শিক্ষকের নিষ্ঠুরতার চাইতে তাঁর উদাসীনতা অনেক বড় ঝুঁকি বলে মনে হয়। স্কুলশিক্ষক বা প্রাইভেট টিউটর দু-ঘা দিচ্ছেন মানে, তিনি খেয়াল করছেন যে সন্তান অমনোযোগী। বাবা-মা তাতে আশ্বস্ত হচ্ছেন। স্কুলে শাস্তিকে ‘শিশু নির্যাতন’ বলে দেগে দেওয়ার ফল কী হচ্ছে? শিক্ষকদেরই একাংশ বলছেন, এর ফলে তাঁরা অবাধ্য ছাত্রদের জোর করছেন না। কেবল আগ্রহী, ভাল পড়ুয়াদের পড়াচ্ছেন। পিছিয়ে-পড়া পড়ুয়াদের নিয়ে আলাদা ক্লাসের কথা বলা হয়, কিন্তু ক’টা স্কুলে তা হয়?

সমস্যা যে শুধু পড়ুয়ার নয়, শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা অনেক, তা শিক্ষকেরাও বোঝেন। নদিয়ার একটি স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক দূর্বাদল দত্ত বলেন, সব পড়ুয়াকে একই স্কেলে মাপা ঠিক হচ্ছে না। সন্তানের থেকে প্রত্যাশার মাত্রা কমাতে হবে বাবা-মাকে। মারধর, বকাবকি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে, তা-ও বুঝতে হবে। কী ভাবে দৈহিক শাস্তি না দিয়েও দুরন্ত শিশুকে বাধ্য করা যায়, তা বোঝার জন্য অভিভাবক ও পড়ুয়ার কাউন্সেলিং দরকার। কিন্তু যেখানে কলকাতার মতো শহরের সব স্কুলে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা নেই, গাঁ-গঞ্জের স্কুলে তা কতটা সম্ভব?

আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা তখনই সম্ভব যখন স্কুল, পরিবার, সমাজে সকলের মানসিকতা ‘তারে জমিন পর’ ছবির নিকুম্ভ স্যরের মতো হবে (ছবিতে)। যখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হবে মানসিক সাহচর্যের, যখন অঙ্কনের প্রতিভা আর অঙ্কের নম্বরকে সমান মর্যাদা দেবে স্কুল। এটা কি বাস্তব পরিস্থিতি? সমাজের কাছে ‘আনন্দময় শিক্ষা’ যত দিন একটা আবছা আদর্শ হয়ে থাকবে, তত দিন পড়াশোনার সঙ্গে ভালবাসার সংযোগ বার বার ভেঙে পড়তে চাইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন