গার্ড অব অনার। ১৯ মার্চ, ১৯৪০-এ রামগড়ে ‘অ্যান্টি-কম্প্রোমাইজ কনফারেন্স’-এ। ফাইল ছবি
হৃদয় বড় অদ্ভুত জিনিস। ঐ যে ‘ইশকিয়া’ সিনেমায় নাসিরুদ্দিন শাহ আর আরশাদ ওয়ারসি-র ঠোঁটে একটা গান ছিল না, ‘দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি...’। সত্যিই আমাদের হৃদয় বড়ই কোমল, বড়ই ‘নাজুক’। সেই যে ছোটবেলায় হৃদয়ে সুভাষচন্দ্র বসুর ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার ছবিটা গেঁথে গেল, তার পরে তাঁর থেকে আমরাই বা মুক্তি পেলাম কোথায়, ‘নেতাজি’-ই বা সেই ভাবমূর্তি থেকে বেরোতে পারলেন কবে?
এই যে যুদ্ধ বিমুখ বাঙালি জাতি, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর যাঁকে ‘দুধে-ভাতে’ করে রেখে গিয়েছিলেন, সেই জাতির একমাত্র ‘বীরপুরুষ’। নরেন্দ্র মোদীর সরকার তাঁকে বা তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে, ২১ অক্টোবর লালকেল্লায় পতাকা তুলে আসলে ‘নেতাজি’-কে সম্মানিত করলেন, না এনডিএ সরকারকে সত্যিই সব অর্থে ‘বহুজনহিতায়’ করে তুলতে পারলেন? আমি ইতিহাসের সামান্য ছাত্রী হিসাবে মনে করি, দ্বিতীয়টায় বেশি সত্যি।
মনে রাখবেন, সুভাষচন্দ্র বসুর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বা ‘মুসলিম প্রীতি’র কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের যদি একটি ভিত্তি হয় দেশপ্রেম, তবে অপরটি অবশ্যই ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। আর মানবীবিদ্যা চর্চার নিরিখে বলতে পারি, সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর রাজনীতিতে, তাঁর তৈরি সেনাবাহিনীতেও নারীকে আলাদা মর্যাদা এবং গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ওই যে সামরিক উর্দিতে তিনি ভারতীয় নারীকে সাজিয়ে ফেললেন, এবং তাঁদের কুচকাওয়াজে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ গাইতে দিলেন—আমার মনে হয়, ক্ষমতার অলিন্দে নারীর প্রবেশাধিকারের ছাড়পত্র মিলে গেল। সেই সুভাষচন্দ্রকে ২১ অক্টোবর লালকেল্লার প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে স্মরণ করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যতটা না নেহরু-গাঁধী পরিবারকে বিঁধতে পারল, তার চেয়েও বেশি করে হয়তো বাঙালির ‘আহত’, ‘অপমানিত’ গরিমায় কিছুটা প্রলেপ লাগাতে পারল।
বাঙালির কোন ‘আহত গরিমা’য় প্রলেপ? এই যে ‘বাঙালি যুদ্ধ করতে পারে না’, এই যে আমাদের নামে ‘ভীরু’ বলে অপবাদ, সুভাষচন্দ্র বসুর ‘রণনায়ক’ হিসেবে ভাবমূর্তি, ১৯৪৫ সালে তাঁর ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে আজাদ হিন্দ ফৌজকে নিয়ে পৌঁছে যাওয়া, এ সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ ছিল।
বাঙালির যুদ্ধের ইতিহাসে শশাঙ্ক যদি হন সবচেয়ে বড় মাইলফলক, যিনি উত্তর ভারতের দাপুটে রাজা হর্ষবর্ধনকে হেলায় হারিয়ে দিয়েছিলেন, তবে একই সঙ্গে এটাও সত্যি যুদ্ধ বিজয়ী শশাঙ্ক নিজের রাজত্বকে উত্তর ভারতে বিস্তৃত করার কথা ভাবেননি। তাই বাঙালির কোনও দিন রণবলে বলীয়ান এমন কোনও নায়ক বা ‘আইকন’ নেই। বারো ভুঁইয়ারা মুঘল সেনাপতি মান সিংহের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়লেন বটে, কিন্তু যুদ্ধে তো শেষ পর্যন্ত সেই দিল্লির মুঘল সম্রাটের রাজপুত সেনাপতিরই জয় হয়েছিল।
সুভাষচন্দ্র বসু এই বাঙালি লোকগাথায় শুধু নায়ক নন, দুদ্ধর্ষ সেনা নায়ক। নায়ক হিসাবে যিনি শুধু কংগ্রেস সভাপতি হননি, পরবর্তীকালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর প্রতিনিধি পট্টভি সীতারামাইয়াকে নির্বাচনে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। শশাঙ্কের হর্ষবর্ধনকে যুদ্ধে পরাভূত করার পরে, ভারতভূমে বাঙালির হৃদয় কুলপতি হিসেবে এ রকম উত্থান আর কোন রাজনীতিকের হয়েছিল?
এই যে ‘প্রতিষ্ঠা’, সেটাকেই সুভাষচন্দ্র আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে, বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি করে এবং জাপানের সহযোগিতায় সেই বাহিনীকে নিয়ে মণিপুরে পৌঁছে গিয়ে। ‘ভীরু জাতি’র ‘মিথ’কে চুরমার করে দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি সে দিন থেকেই আমাদের হৃদয়ে পাকাপাকি ভাবে গাঁথা হয়ে গিয়েছে। তাঁর ‘দিল্লি চলো’ স্লোগান আসলে আহত, অপমানিত বাঙালি জাতির দিল্লি দখলের ডাক।
কর্ণ বনাম অর্জুনের মতো, কিংবা পেলে বনাম মারাদোনার মতো ‘নেহরু বনাম নেতাজি’ও একটা কখনও শেষ না হওয়া বিতর্ক। এবং আমাদের অনেকেরই ‘নাজুক’ বাঙালি হৃদয় সব সময় নেতাজির পক্ষে ভোট দিয়ে এসেছে। ইতিহাস কী বলল, নথি কী বলছে, তাতে কী আসে যায়? ‘যা হয়েছে’র চাইতে আমরা চিরকালই বিশ্বাস করি, ‘যা হতে পারত’তে। কুরুক্ষেত্র জয়ী অর্জুন নয়, ভাগ্য বিড়ম্বিত কর্ণকে নিয়েই যেমন বাঙালি শোকগাথা রচনা করেছে, তেমনই জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া দেবদাস তো আমাদের অন্যতম ‘আইকন’।
‘যা হতে পারত’র প্রতি আজন্ম মুগ্ধতায় থাকা বাঙালি সে কারণেই সুভাষচন্দ্র বসুকে সারা জীবন সবার উপরে স্থান দিয়ে এসেছে। ২১ অক্টোবর কি এই মুগ্ধতায় আর একটু শিলমোহর দিলেন নরেন্দ্র মোদী? যা বাঙালি আজন্ম চেয়েছে, তার আবাল্যের স্বপ্ন, তাকেই কি স্বীকৃতি দিল নয়াদিল্লি?
‘সোশ্যাল মিডিয়া’য় ঝড় ‘সুভাষচন্দ্র বসুই অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী’, ২১ অক্টোবরই ‘ভারতের নতুন স্বাধীনতা দিবস’। এমনতর নানা বিশেষণে এবং ইতিহাসের নতুন নতুন ‘সত্য’ উন্মোচনে আমরা হয়তো বিভ্রান্ত। সত্যিই কি তা হলে ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখা শুরু হল? তবে কি নেহরু, গাঁধী পরিবারের বাইরে অন্য দেশপ্রেমিকদের কৃতি পাওয়া শুরু হবে? ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে বলতে পারি, ইতিহাসের অতি সরলীকরণ করা যায় না। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বা স্বাধীনোত্তর ভারতেও নেহরু, গাঁধী পরিবারকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হত, তা থেকে হয়তো সরে আসার পর্ব শুরু হল। আর মোদী সমর্থক হোন, না হোন, বাঙালি হিসেবে অন্তত ইতিহাসের এই নতুন ধারা বিবরণীকে স্বাগত জানাতে পারেন।
ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে তাই এক দিকে যেমন ‘নেতাজি’কে এই সম্মান জানানোকে আমি বাঙালির প্রাপ্তি হিসেবে দেখব, তেমনই ইতিহাস ভালবাসার কারণে তার অতি সরলীকরণকেও গুরুত্ব দেব না।
শুরুতেই বলেছিলাম, সুভাষচন্দ্র বসুর আসল ছবিটা আঁকা রয়েছে বাঙালির হৃদয়ে। এটুকু বুঝি, ‘আইকন’-এর কোনও স্বীকৃতি লাগে না বরং অনেক সময় ‘আইকন’ আপনাকে সাহায্য করে ভাবমূর্তি নির্মাণ করতে।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক