‘শেখা’র মানসিকতা কই
National Anthem

“কিছু কিছু জিনিস আছে যাকে ‘রেসপেক্ট’ করতে হয়”

কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোনও সংবাদপত্র, সরকারি দফতর অথবা রাজনৈতিক ক্ষেত্র, যেখানেই হোক, কোনও ব্যক্তি যদি ক্ষমতার শীর্ষে বা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন, তা হলে তাঁর স্বভাবে একটি পরিবর্তন হয়। দ্রুত তাঁর চরিত্রে এসে বাসা বাঁধে দম্ভ।

Advertisement

জয় গোস্বামী

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০০
Share:

খবরে পড়লাম, বিজেপির সাংসদ এবং ওই দলের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী রবীন্দ্রনাথের লেখা আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীতটি বদলাতে চেয়েছেন। এ কথাও জানতে পারলাম, এই বদল বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে দ্রুত সাড়া পেয়ে খুবই উৎফুল্ল আছেন এখন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। স্বামীর মতে, রবীন্দ্রনাথের লেখা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কিছু কিছু শব্দ অনাবশ্যক বিভ্রম তৈরি করছে। স্বামী, বিশেষ ভাবে, এই গানে ‘সিন্ধু’ শব্দটি বদলাতে চান। নিজের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি দাঁড় করিয়েছেন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের একটি বক্তব্যকে। ১৯৪৯ সালে, রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেছিলেন, জাতীয় সঙ্গীতের শব্দ সংশোধন বা পরিবর্তন করা যেতে পারে।

Advertisement

এই সংবাদ পড়ে আমি স্তম্ভিত! ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি বার বার দেখেছি, কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোনও সংবাদপত্র, সরকারি দফতর অথবা রাজনৈতিক ক্ষেত্র, যেখানেই হোক, কোনও ব্যক্তি যদি ক্ষমতার শীর্ষে বা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন, তা হলে তাঁর স্বভাবে একটি পরিবর্তন হয়। দ্রুত তাঁর চরিত্রে এসে বাসা বাঁধে দম্ভ। ‘আমি সব জানি, সব বিষয়ে আমার ব্যুৎপত্তি আছে’— নিজের সম্পর্কে এই ধারণা দ্বারা তিনি চালিত হন। সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করেন না। নিতান্ত তরুণদেরও দেখেছি, কিছু প্রতিপত্তি অথবা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার পেলে, তাঁরা মনে করেন, সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছেন।

সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, সর্বভারতীয় স্তরে, এক জন উঁচু দরের বিজেপি নেতা। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি পদের অধিকারী রাজেন্দ্রপ্রসাদ দেশের প্রথম নাগরিক। এই বার তাঁরা মনে করছেন রবীন্দ্রনাথের লেখায় তাঁরা শব্দবদল করারও অধিকার পেয়ে গিয়েছেন।

Advertisement

রোহিত শর্মা তখন এক জন ‘আপকামিং’ ব্যাটসম্যান। সবে প্রথম দু’তিনটি আন্তর্জাতিক ওয়ান-ডে ম্যাচ খেলায় দলে ঢুকেছেন। আজকের মতো সাফল্যপ্রাপ্ত তারকা ক্রিকেটার হয়ে ওঠেননি। একটি আন্তর্জাতিক ওয়ান-ডে ম্যাচে তিনি ১৬ রান করে আউট হয়ে গেলেন। ওই ১৬ রান এল খুব দ্রুত এবং দৃষ্টিনন্দন চারটি বাউন্ডারির মাধ্যমে।

তার পর এক সময় খেলা শেষ হয়েছে। টিভিতে পর্যালোচনায় অংশ নিচ্ছেন সুনীল গাওস্কর। এক জন সাংবাদিক গাওস্করকে প্রশ্ন করছেন, গাওস্কর প্রত্যেকের খেলার বিশ্লেষণ করে চলেছেন।

অতঃপর রোহিত শর্মার প্রসঙ্গ এল। গাওস্কর বললেন, “হি লাভস টু প্লে শটস। ওর হাতে সব রকমের স্ট্রোক আছে। মাঠের সব দিক দিয়েই রোহিত শর্মা বল পাঠাতে পারে। তবে এখনও ওর একটা জিনিস শেখা বাকি। যদি রোহিত সেটা শিখে নেয়, তবে ওকে আমরা প্রমিসিং প্লেয়ারের বদলে এক জন কমপ্লিট এক ম্যাচিয়োর ব্যাটসম্যান বলতে পারব।”

টিভির সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, কী শেখা বাকি আছে? গাওস্কর উত্তরে যে-কথাটি বললেন, সে কথা আমি জীবনেও ভুলব না। তিনি বললেন, “ওকে এখন শিখতে হবে, এমন কিছু কিছু ডেলিভারি আছে, যাকে ‘রেসপেক্ট’ করা দরকার। সব বলে স্ট্রোক নেওয়া যায় না।”

হ্যাঁ, ‘রেসপেক্ট’ কথাটাই ব্যবহার করেছিলেন গাওস্কর।

রবীন্দ্রনাথ এক জন কবি ছিলেন, তাঁর বই গীতাঞ্জলি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিল, এ কথা কে না জানে! তবে রবীন্দ্রনাথ শুধু নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, এ কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি এ কথাটাও বলতে চাই যে, বিশ্বের দু’জন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও লেখক তাঁর কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। এক জন হুয়ান রামন হিমেনেথ, স্পেনের কবি। অন্য জন, আঁদ্রে জিদ, ফরাসি লেখক। দু’জনেই নোবেল পেয়েছিলেন। ফরাসি ভাষার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক চিন্ময় গুহ আর একটি তথ্য জানিয়েছেন যে, ফরাসি ভাষার এক জন প্রধান কবি, সাঁ-জঁ-প্যার্স, ছুটে গিয়েছিলেন অগ্রজ লেখক আঁদ্রে জিদের কাছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই এবং সেই সঙ্গে এক রকম প্রায় আকুল অনুরোধ সঙ্গে নিয়ে যে, “আপনি এই কবির লেখা অনুবাদ করুন। এমন কোনও কবিদৃষ্টি আমাদের পাশ্চাত্যে এখন নেই।”

বললামই তো, আঁদ্রে জিদ অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে— যা এখনও বলিনি তা হল, এই ফরাসি কবি, সাঁ-জঁ-প্যার্স, ১৯৬০ সালে ইনিও নোবেল পুরস্কার পান। আর এ কথাও সবার জানা যে, আর এক জন নোবেলপ্রাপ্ত কবি, ইয়েটস, যখন প্রথম গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি হাতে পান এবং পড়েন, তখন কেমন ভূতগ্রস্তের মতো সেই পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে সারা ক্ষণ যাপন করতেন। বার বার পড়তেন।

এই বার ধরা যাক, আমি, এক জন উচ্চশ্রেণির বিজেপি নেতা, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, আমি কি জানি ওই চার জন নোবেলপ্রাপ্ত কবি ও লেখক— আঁদ্রে জিদ, হিমেনেথ, ইয়েটস, সাঁ-জঁ-প্যার্স— এঁদের বিশেষত্ব কী? এঁরা কেন রবীন্দ্রনাথকে ওই পরিমাণ ‘রেসপেক্ট’ দিয়েছিলেন? আমি দেশের রাষ্ট্রপতির পদপ্রাপ্ত হয়েছি— আমি দেশের প্রথম নাগরিক, রাজেন্দ্রপ্রসাদ— আমি কি জানি, রবীন্দ্রনাথের লেখায় শব্দের পরিবর্তন বা সংশোধন করা যেতে পারে, এ কথা বলার যোগ্যতা আমার আছে কি না? কাব্যসাহিত্য বিষয়ে কোনও গভীর বীক্ষা কি আমার আছে? অথবা, আমি বিজেপির এক সর্বভারতীয় স্তরে উচ্চপদাধিকারী নেতা, সুব্রহ্মণ্যন স্বামী, আমি প্রধানমন্ত্রীর সাড়া পেয়ে উৎফুল্ল আছি কেন? কারণ, নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী আমার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেননি! যদি বিরোধিতা করতেন, তা হলে নিশ্চয়ই আমি উৎফুল্ল হয়ে টুইট করতাম না!

উচ্চপদে আসীন হলেই মানুষ প্রচুর স্তাবক পায়। ক্ষমতার স্তম্ভে উঠলেই স্তম্ভের তলায় স্তাবকরা ভিড় করে আসবে। এবং আমার মধ্যে এই মূর্খ-ধারণা তৈরি করে দেবে যে, আমি সব বিষয়ে মতামত দেওয়ার এবং সব কিছুকে সংশোধন করার অধিকারী। এমনকি রবীন্দ্রনাথের লেখায় শব্দবদলেরও সাহিত্য-শক্তি আমার আছে, যে হেতু রাজনৈতিক ভাবে আমি উচ্চক্ষমতার চেয়ারে বসে আছি।

তা হলে গাওস্করের কথাটার কী হবে? কিছু কিছু ডেলিভারিকে ‘রেসপেক্ট’ করা দরকার— এই কথাটার প্রয়োগমূল্য কী?

ক্ষমতার দিকে তাকালে এই কথাটির প্রয়োগমূল্য হল, আমার যিনি কর্তা বা বস— এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী— তাঁকে ‘রেসপেক্ট’ করা। তাই প্রধানমন্ত্রীর সাড়ায় আমি উৎফুল্ল।

রোহিত শর্মা নিশ্চয়ই গাওস্করের কথাটা মান্য করেছিলেন যে, কিছু ডেলিভারিকে ‘রেসপেক্ট’ করতে হয়, তাই আজ তিনি এত বড় ব্যাটসম্যান হতে পেরেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের কে বোঝাবে যে রবীন্দ্রনাথ, এই সমগ্র সত্তাটি, ভারতবাসীর কাছে কী চূড়ান্ত ভাবে ‘রেসপেক্ট’ শব্দটি দাবি করে!

যে জাতীয় সঙ্গীত এখনও বহাল আছে, কত দিন থাকবে জানি না, সেই জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে উদার বিরাট এক মহিমময় ভারতবর্ষের জয়গাথা আমাদের অন্তরকে উদ্বোধিত করে। এই লেখা যখন রচিত হয়েছিল, তখন অখণ্ড ছিল ভারতবর্ষ। রাজনৈতিক নেতারা সেই ভারতবর্ষকে খণ্ডিত করেন। এ বার তাঁরা রবীন্দ্রনাথের লেখার শব্দ পরিবর্তন ও সংশোধন করার কথা তুলেছেন। অর্থাৎ, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকেও খণ্ডিত করবেন।

যাঁর যাঁর নিজস্ব ক্ষেত্র থাকে। রাজনীতির ক্ষেত্রে অথবা কূটনৈতিক বুদ্ধির খেলায় তাঁদের পারদর্শিতা থাকতে পারে, এ কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু কবিতার সূক্ষ্মতা নিয়ে কখনও কি চর্চা করেছেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী? অথবা ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ? আমরা কিন্তু তেমন কোনও প্রমাণ পাইনি। অথচ দেখা যাচ্ছে, এঁরা মনে করেন রবীন্দ্রনাথের রচনা এঁদের হাতে সংশোধনযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতও মূলত কবিতা। কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতায় বলশালী হয়ে উঠলেই কারও অধিকার জন্মায় না, সেই সৃষ্টিকে সংশোধন করে তাকে অসম্মানের দিকে ঠেলে দেওয়ার। অল্প কিছু দিন আগেই আমরা দেখেছি বিপুল পরাক্রমশালী নেতা অমিত শাহের মিছিল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে একদল যুবক বিদ্যাসাগরের মূর্তি খণ্ড খণ্ড করে দিচ্ছে। এদের হাতে যদি রবীন্দ্র-সৃষ্টি এ বার খণ্ডিত হওয়ার পথে এগোয়, আমরা জানি না, আমরা কী করতে পারি। আমরা দেশবাসী, যারা রবীন্দ্রপ্রেমী, এইটুকু শুধু বলব, তোমার হাতে যদি দেশের শাসনভার থাকে, তোমাকে যদি দেশ চালাতে হয়, তা হলে কিছু কিছু জিনিসকে ‘রেসপেক্ট’ করা তোমাকে শিখতে হবে। রবীন্দ্রনাথের গায়ে হাত দিয়ো না।

কিন্তু এই শাসকদের কিছু শেখার মতো মানসিকতা আছে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন