তদন্তের নামে

কাশ্মীর এমনই একটি অঞ্চল, যেখানে এক দিকে সন্ত্রাসের আতঙ্ক তাড়া করিয়া ফিরে, অন্য দিকে সন্ত্রাসের তদন্তে কোনও না কোনও ভাবে— অনেক সময় অকারণে— জড়াইয়া পড়িবার ভয় রাতের নিদ্রা হরণ করে

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

সদ্য জামিন প্রাপ্ত জ়াহুর ওয়াতালি। ফাইল চিত্র।

সন্ত্রাসবাদ বস্তুটি কত ভীতিজনক, ভারতবাসীকে তাহা বুঝাইতে হইবে না। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের তদন্তও যে কত ভীতিজনক হইতে পারে, তাহা সম্ভবত এখনও এ দেশের নাগরিক সমাজের কাছে পরিষ্কার নহে। সন্ত্রাসের তদন্তের নামে যাহা চলে, তাহাতে অনেক সময় নিরপরাধ কিংবা লঘু অপরাধে অপরাধী ব্যক্তির জীবনরেখা সপাট পাল্টাইয়া যাইতে পারে, এবং যে হেতু সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপেক্ষা নিষ্ঠুরতর আইন এ দেশে বেশি নাই, তাই সেই সরকারি ভ্রান্তির দাম অনেক সময় নাগরিককে প্রাণ দিয়া গনিতে হয়। কাশ্মীর এমনই একটি অঞ্চল, যেখানে এক দিকে সন্ত্রাসের আতঙ্ক তাড়া করিয়া ফিরে, অন্য দিকে সন্ত্রাসের তদন্তে কোনও না কোনও ভাবে— অনেক সময় অকারণে— জড়াইয়া পড়িবার ভয় রাতের নিদ্রা হরণ করে। জ়াহুর ওয়াতালি এমনই এক জন সত্তর বৎসর বয়সি কাশ্মীরি ব্যবসায়ী, যিনি গত বৎসর অগস্ট মাসে সন্ত্রাসগোষ্ঠী লস্কর-এ-তইবাকে অর্থজোগানের দায়ে এনআইএ বা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি দ্বারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন। এক বৎসরের অধিক কারাবাসের পর গত বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, দিল্লি হাই কোর্ট তাঁহার তৎক্ষণাৎ জামিন মঞ্জুর করিল। সঙ্গে বাহির হইল একটি চল্লিশ পৃষ্ঠার রায়, যাহাতে হাই কোর্টের বিচারপতিদ্বয় এস মুরলীধর এবং বিনোদ গোয়েল দুই জনই মারাত্মক পদ্ধতিগত ত্রুটির অভিযোগ তুলিলেন এনআইএ-র বারো শত পৃষ্ঠার চার্জশিটটির বিরুদ্ধে। কোনও ব্যক্তিনাগরিকের দৃষ্টি হইতে দেখিলে, সমগ্র ঘটনাটি আতঙ্কে শিহরন জাগাইবার মতো। আশঙ্কিত হইয়া ভাবিতে হয়, এই যদি জাতীয় স্তরে তদন্তের গতিপ্রকৃতি হয়, তাহা হইলে কাহাদের হস্তে দেশের সুরক্ষার ভার ন্যস্ত রহিয়াছে।

Advertisement

বিচারপতিদের মূল বক্তব্য: যে অভিযোগ ওয়াতালির বিরুদ্ধে আনা হইয়াছে, পেশ-করা নথিপত্রের একটিতেও সেই অভিযোগ সমর্থিত হয় না। এবং আদালত চাওয়া সত্ত্বেও অন্য কোনও নথি এনআইএ জোগাড় করিতে পারে নাই। ওয়াতালি শ্রীনগরে বড় ব্যবসার-কাজে নিযুক্ত, একাধিক ব্যবসায়িক অফিস তিনি চালাইয়া থাকেন, এবং প্রকাশ্যেই তাঁহার ব্যবসায়ের মূল জোর ভারত-পাক সীমান্ত পারাপারকারী বাণিজ্যের উপর। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণেই তাঁহাকে অপরাধী বলিয়া প্রতিষ্ঠা করা তো সম্ভব নয়। এ দিকে যে বিরাট পরিমাণ নথি এনআইএ আদালতে জমা দিয়াছে, তাহার কোনওটিতেই লস্কর বা অন্য কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর সহিত তাঁহার যোগ দেখা যাইতেছে না। কাগজপত্রের বাহিরেও এক ধরনের ঘটনাচক্রের প্রমাণ হইতে পারে, কিন্তু তাহা দিয়াও ওয়াতালির সঙ্গে জঙ্গিদের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় নাই। ওয়াতালির তৎক্ষণাৎ জামিন আদেশের সহিত আদালতের রায় এনআইএ-র উপর দুই লক্ষ টাকার জরিমানাও চাপাইয়াছে। অকারণে নাগরিককে হেনস্থা করিবার জন্যই এই জরিমানা। সস্তা ফিল্মি-মার্কা এই ঘটনায় যে কেবল কেন্দ্রীয় দফতরটির অদক্ষতা প্রকাশিত, তাহাই নয়, পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক মনোভাবও স্পষ্টত পরিস্ফুট। এই সেই রাজনীতি যাহা ধরিয়া লয়, শ্রীনগরের মুসলিম ব্যবসায়ী পাকিস্তানের সহিত ব্যবসা করিতেছেন মানেই তিনি নিশ্চিত ভাবে সন্ত্রাসবাদী, তাঁহার জন্য আর নথিপত্রের প্রমাণ কেন-ই বা দরকার। বিজেপি সরকারের মুসলিম-ফোবিয়ার ন্যক্কারজনক দিকটি এই ঘটনায় স্পষ্ট। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চাই, কাশ্মীর ভারতেরই অংশ, ইত্যাদি বলিয়া যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত দিল্লিতে আস্ফালন করেন, কাশ্মীর উপত্যকায় উপস্থিত হইলে সেই সরকারের প্রকৃত মুখটি কত হিংস্র, এই ঘটনা তাহা দেখাইয়া দেয়। এই সরকারের সন্ত্রাস-তদন্ত এক দিকে ব্যর্থ, অদক্ষ, দিশাহীন। অন্য দিকে সংখ্যালঘু-বিরোধিতায় তাহা দুর্মর। ইতিমধ্যে ওয়াতালির মতো দৃষ্টান্তগুলি কাশ্মীরকে প্রত্যহ ভারত হইতে দূরে, আরও দূরে লইয়া যাইতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন