তাজমহল: ‘দশ দিক ঘিরে যমুনার কোল ভর্তি করে কেবলই বিস্তীর্ণ জঞ্জালের স্তূপ’। গেটি ইমেজেস
বন্ধ করে দিন! ভেঙে ফেলুন! নষ্ট করে দিন! আপনারা যা চান তা-ই করুন!— দেশের সরকারকে বলছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। প্রসঙ্গ: দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সৌধের রক্ষণাবেক্ষণ। এমন দেশটি কেউ কোথাও খুঁজে পাবে না যেখানে এ রকম ভাষায় ও ভঙ্গিতে সরকার ভর্ৎসিত হয় বিচারবিভাগের কাছে। গত সপ্তাহে একাধারে এ দেশের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে তুলোধোনা করলেন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গ্রিন বেঞ্চের বিচারপতি লোকুর এবং দীপক গুপ্ত। তাঁদের বক্তব্য: এই ভাবে তিলে তিলে তাজমহলের সর্বনাশ ঘনিয়ে এনে কী লাভ, এক বারে শেষ করে দিলেই তো হয়!
কিসে এতখানি ক্ষিপ্ত তাঁরা? ক্ষিপ্ত, কারণ তাঁরা দেখছেন, কলকারখানাজনিত দূষণ যাতে সৌধটি নষ্ট না করে দেয় সে বিষয়ে অনেক বার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে গ্রিন বেঞ্চের পক্ষ থেকে, তাজ-সংলগ্ন সংরক্ষিত অঞ্চলে নতুন নির্মাণকাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা (মোরাটরিয়াম) জারি করে রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট, অথচ তার পরও, আগরার তাজ ট্রাপিজ়িয়ম জ়োন-এর দায়িত্ববাহী কর্তৃপক্ষ নতুন করে বিভিন্ন কারখানার পরিধি বাড়ানোর আবেদনপত্র জমা নিচ্ছে— এটা জেনেই যে সংরক্ষিত এলাকাতেই ‘এক্সটেনশন’ চান শিল্পপতিরা!
কেবল শিল্পজনিত দূষণ? যমুনা-তীরে ‘এক বিন্দু নয়নের জল’ মহলটির দশ দিক ঘিরে যমুনার কোল ভর্তি করে কেবলই বিস্তীর্ণ জঞ্জালের স্তূপ। সেই স্তূপ থেকে সারা দিন হাওয়ায় উড়ে আসা, পাখির মুখে ঘুরে আসা নোংরায় শ্বেত-সৌধ একটু একটু করে পীত-সৌধে পরিণত হচ্ছে। মানুষের পায়ে পায়ে জলকাদা থেকে শেওলার উজ্জীবনে সবুজের ছাপও পড়ছে সেই ঘনায়মান হলুদে। অবশ্যই কোনও একটিমাত্র সরকারের আমলে এই অনাচার ঘটেনি। তবে কিনা, যে সরকারের স্বচ্ছ ভারতের মহৎ বাণী স্কুলপাঠ্য বইয়েও স্থান করে নিচ্ছে, সেই সরকারের আমলে এর কোনও প্রতিকারও ঘটেনি। গঙ্গাদূষণের মতো ভয়ঙ্কর উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প নিয়ে মন্ত্রক তৈরি হয়েছে, কিন্তু তাজমহলের দূষণ রোধে সে অঞ্চলে শিল্পকারখানার বিস্তার থামানো হয়নি।
আদালতের তীক্ষ্ণ বঙ্কিম পর্যবেক্ষণ: টিভি টাওয়ারের মতো দেখতে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, তবু তাকে দেখতেও ফ্রান্সে প্রতি বছর যত লোক যান, বিশ্বের সাত আশ্চর্যের এক আশ্চর্য তাজমহলকে দেখতে আসেন তার আট ভাগের এক ভাগ মানুষ। বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের জন্যও তো সৌধটিকে সুন্দর করে রাখা যেত?— বেঞ্চের প্রশ্ন।
প্রশ্নটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু বিধিনিয়ম মেনে ওখানেই থেমে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ। সুবর্ণসুযোগ থাকা সত্ত্বেও পরিবেশ ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জিজ্ঞাসা করতে পারেনি, ‘দেশ’ ও ‘জাতীয় গৌরব’ নিয়ে যে সরকারের দিনরাত এত মাতামাতি, জাতীয়তাবাদের হুহুঙ্কারের চোটে অন্য সব কাজকর্ম মাথায় ওঠায়, এমন একটি বিস্ময়-সৌধ নিয়ে সেই সরকার কেন এতখানি অবজ্ঞাময়?
না, তাজমহলের প্রতি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিটি জাতীয়তাবাদ-বিরহিত ভাবলে ভুল হবে। বরং এর মধ্যে আছে এই সরকারের নতুন এবং নিজস্ব জাতীয়তাবাদের অভ্রান্ত ছাপ। এই জাতীয়তার হিসেবটাই অন্য রকম। এখানে ‘শত্রু’ মুসলিমদের তৈরি কোনও জিনিস গৌরবজনক হতেই পারে না। এত কাল যে সৌধটির সঙ্গে রাজনীতির প্রত্যক্ষ যোগ কেউ কখনও আবিষ্কার করতে পারেননি, তাকেও অবলীলায় রাজনৈতিক বিতর্কের বস্তু করে ফেলেছেন নতুন ভারতের নেতারা। উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার রাজ্যের পর্যটন মানচিত্র প্রকাশ করেছে, তাতে তাজমহলের উল্লেখও থাকেনি! থাকবে কী করে, সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত ওই রাজ্যে ভোটের অঙ্কে গোলযোগ এড়াতে হলে হিন্দুত্ববাদী ভোটব্যাঙ্কটাকে তো বাড়াতে হবে। আর, বিজেপির ভোট বাড়াতে হলে ধর্মীয় মেরুকরণই তো শ্রেষ্ঠ উপায়। ‘জাতীয়তাবাদী’ সরকারের কাছে তাজমহল আপাতত মেরুকরণের জন্য বলিপ্রদত্ত।
রাজ্যের ভোটারদের হাতে হাতে পর্যটন মানচিত্র না-ও পৌঁছতে পারে, তাই ভোটারদের কানে কানে পৌঁছনোর জন্য বিজেপি বিধায়ক সঙ্গীত সোম বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন: যে মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল বানিয়েছিলেন, তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ‘হিন্দুদের ধ্বংস’ করা। তাই রাজ্য সরকার অতঃপর তাজমহলকে আর কোনও অর্থসাহায্য করবে না। শাহজাহান বিষয়ে এই তথ্য কোথায় পাওয়া যায় ইতিহাসবিদরা জানেন না। কিন্তু ইতিহাসবিদদের প্রয়োজনটাই বা কী। নতুন জাতীয়তাবাদের জন্য নতুন ইতিহাস-রূপকাররা আছেন। সঙ্গীত সোম রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছেন, উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার ‘ইতিহাসকে ঠিক পথে আনার’ চেষ্টা করছে: ‘ট্রাইং টু ব্রিং হিস্টরি ব্যাক টু দ্য রাইট ট্র্যাক’।
সোমের থেকে উঁচু পদে কিংবা বড় গুরুত্বে দলের যে নেতারা অধিষ্ঠিত, তাঁরা কেউ সোমের ‘রাইট ট্র্যাক’ নিয়ে মুখ খোলেননি। মৌন যে সম্মতির লক্ষণ এবং উস্কানির অস্ত্র, প্রধানমন্ত্রী মোদীর দল তা বিলক্ষণ জানে। অবশ্য, সমস্যা দেখা দিল বিষয়টা আন্তর্জাতিক প্রচারে আসতে শুরু করায়। মুখ্যমন্ত্রী যোগী ভালয় ভালয় যোগ করে দিলেন একটি বাক্য: হ্যাঁ, যে-ই বানিয়ে থাকুক না কেন তাজমহল, ‘ভারতীয়’দের ঘামরক্ত মিশে আছে ওর সঙ্গে। ইঙ্গিত— সৌধটি বানিয়েছিলেন যে ‘অভারতীয়’রা, ‘ভারতীয় অর্থাৎ হিন্দুদের’ উপর তাঁরা জবরদস্তি অত্যাচার করেছিলেন। যদিও যে কোনও সময় যে কোনও সমাজেই শ্রমিকদের উপর রাজন্যবর্গের অত্যাচার চলে— তাজমহল তৈরিতে যে হিন্দুদের উপরেই বেছে বেছে অত্যাচার ঘটেছিল, এ কিন্তু কোনও ‘তথ্য’ নয়। পঙ্কিল কল্পনা মাত্র।
‘ঐতিহাসিক’ তথ্যের জন্য অবশ্যই সেই লেখকদেরই আশ্রয় নিতে হবে, যাঁরা ইতিহাসকে ‘রাইট ট্র্যাক’-এ আনতে ব্যস্ত। তাই পি এন ওক নামে এক ইতিহাস-‘পণ্ডিত’-এর কথা আরও এক বার শোনা গেল, যাঁর নাম ইতিহাসবলয়ে কোথাও ঠাঁই না পেলেও আরএসএস ও তার সঙ্ঘীসাথিরা যাঁকে কয়েক দশক ধরেই মাঝে মধ্যে প্রয়োজনমতো খুঁড়ে বার করে আনে। ওক-মশাই-এর পুস্তিকা অনুসারে ঘোষিত হল, তাজমহল মোটেই মুঘল পর্বে বানানো সৌধ নয়, এটি একটি হিন্দু মন্দির, শৈব উপাসনা স্থান, আসল নাম তেজঃ-মহল। পরবর্তী কালে ‘পাষণ্ড মুসলিম’রা একে আত্মসাৎ করে ‘তাজমহল’ বলে দাবি করে। এইটুকুর অপেক্ষা মাত্র— সঙ্গে সঙ্গে প্রায় হাফ ডজ়ন অ্যাডভোকেট আগরা কোর্টে তড়িঘড়ি মামলা ঠুকে দিলেন, এখনই তাজমহলকে ‘তেজোমহাল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক! শিব সেনা ধুয়ো ধরল, তাজমহলে শিবের আরতি শুরু হোক! নানা হিন্দু সংগঠন দাবি তুলল, তাজমহলের মধ্যে মসজিদে নমাজ পড়া বন্ধ হোক!
শেষ পর্যন্ত আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সৌজন্যে এ যাত্রা প্রাণে বাঁচল তাজমহল। কোর্টে হলফনামা জমা পড়ল। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও পৌঁছল। জানা গেল, পত্নী মমতাজ় মহলের স্মৃতিতে সম্রাট শাহজাহান বানিয়েছিলেন তাজমহল।— অন্তত একটা জয় নতুন ভারতের হাতছাড়া হল!
এএসআই তো সর্বত্র বিপত্তারণ হয়ে ছুটে আসবে না। আরও পাঁচ বছর যদি এই ‘নতুন ভারত’-এর জয়যাত্রা চলে? তা যদি হয়, দেশটা তবে ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হয়ে যাবে। কথাটা বলে কত গঞ্জনাই না খেলেন সাংসদ শশী তারুর। ও দিকে এ বছরের গোড়াতেই তেজঃমহল বিতর্কের শেষে আগরা পর্যটন চেম্বার-এর সভাপতি প্রহ্লাদ অগ্রবাল আরও কয়েক মাইল পশ্চিমে গিয়ে বলেছিলেন, তাজমহলের উপর বিজেপি ‘আক্রমণ’-এর সঙ্গে একটাই তুলনা চলতে পারে— তালিবানের হাতে আফগানিস্তানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস!
তালিবান, পাকিস্তান— শব্দগুলো শুনলেই যাঁরা রাগে চিড়বিড় করেন, তাঁরা ভুলে যান বা ভুলতে চান যে শব্দগুলির মধ্যে নিহিত বিদ্বেষবিষ আর অসহিষ্ণুতার কারবারের প্রলয়কে কিন্তু অন্ধ হয়ে বন্ধ করা যায় না। ২০১৪-র আগে এ দেশটায় হিন্দু ধর্মও ছিল, জাতীয়তাবাদও ছিল। তবু তাজমহল নিয়ে তো টানাটানি পড়েনি কখনও। আজ তবে হলটা কী? জঞ্জালস্তূপে পরিবৃত শত্রুসম্পত্তি তাজমহলকে মানচিত্র থেকে উধাও করে দেওয়া, কিংবা হিন্দুত্ব-তেজে তাকে ‘শুদ্ধ’ করে নিয়ে ‘জাতীয় সৌধ’ বানিয়ে নেওয়া— অ্যাদ্দিনের পুরনো ভারতে কি এ সব শোনা যেত? কী চান নতুন ভারতের কারিগররা? দেশটা ভেঙেচুরে তাঁদের ঈপ্সিত হিন্দুত্বে চুবিয়ে নিতে?
বিচারক মশাইদের বকুনিটা তাই শুধু তাজমহল কেন, আমাদের আজন্ম চেনা ভারতবর্ষ বিষয়েও দিব্যি খেটে যায়— ‘ভেঙে ফেলুন, নষ্ট করে দিন। আপনারা যা চান তা-ই করুন!’