সম্পাদকীয় ১

প্রতিরোধের পথ

আদালত কেবল খাপ পঞ্চায়েতের আচরণকে আইনবিরুদ্ধ বলিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, প্রতিকারকল্পে কী কী করা যাইতে পারে, তাহার একটি স্পষ্ট নির্দেশিকাও দিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৮ ০০:০৫
Share:

সর্বোচ্চ আদালত কি সম্প্রতি আর কোনও রায়ে এত কঠিন স্বর ব্যবহার করিয়াছে? সারা দেশে ছড়াইয়া থাকা খাপ পঞ্চায়েতগুলি যেন কোনও প্রাপ্তবয়স্কের বিবাহের ক্ষেত্রে নাক না গলায়— সুপ্রিম কোর্টের দৃঢ় মত। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আদালতের কড়া অবস্থানটি এভাবে স্পষ্ট করিয়া দেওয়ার ফলে খাপ পঞ্চায়েতের অস্তিত্ব রাতারাতি উধাও হইয়া যাইবে, এতখানি ভাবা বাতুলতা। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হইবে, এ-আশা করাই যায়। আদালতের রায় শুনিয়া যেমন বহু খাপ পঞ্চায়েতের তরফে স্পর্ধিত মন্তব্য শোনা গিয়াছে যে, বিচারকরা যাহাই বলুন না কেন, সমাজ রক্ষার জন্য খাপ পঞ্চায়েত সামাজিক প্রথাগুলি মানিয়া চলিবেই, আবার ঠিক সেই রকমই রায় শুনিয়া নিশ্চয় অনেক ব্যক্তি-নাগরিক ও তাহার পরিবারবর্গের মনে সাহসেরও সঞ্চার হইয়াছে যে, শেষ পর্যন্ত এত দিনে সামাজিক অন্যায় প্রতিরোধের কোনও রকম ব্যবস্থা হইল। যে দেশের ঘরে-ঘরেই অদৃশ্য খাপ পঞ্চায়েত ছড়ি ঘুরাইতে বসে, সেখানে প্রতিরোধের এই প্রাথমিক সাহস ও ভরসাটুকু অর্জন করাই কঠিনতম ধাপ। বলা যাইতে পারে, আদালতের রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদার গণতন্ত্রের পথ সুগম হইল, মৌলিক অধিকারের বিপন্ন সাংবিধানিক সংজ্ঞাটির অন্তত কিছু সুরক্ষার ব্যবস্থা হইল।

Advertisement

আদালত কেবল খাপ পঞ্চায়েতের আচরণকে আইনবিরুদ্ধ বলিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, প্রতিকারকল্পে কী কী করা যাইতে পারে, তাহার একটি স্পষ্ট নির্দেশিকাও দিয়াছে। প্রতিরোধ ও প্রতিকার, দুই পর্যায়ে বিন্যস্ত এই নির্দেশিকা অত্যন্ত জরুরি একটি নথি। বিচারবিভাগের সুবিবেচনা যদি শাসনবিভাগ শেষ অবধি কার্যে পরিণত করিতে সমর্থ হয়, তবে দেশের পরিস্থিতি সত্যই পালটাইতে পারে। তবে নির্দেশিকাটি পড়িতে গিয়া যদি কাহারও সংশয় জন্মে যে সরিষার মধ্যেই ভূত থাকিলে ভূত ছাড়ানো অসম্ভব, তাঁহাকে দোষ দেওয়া যাইবে না। পুলিশ বা জেলা প্রশাসনের উপর আদালত অনেকখানি ক্ষমতা অর্পণ করিয়াছে, তাহাদেরই উপর ভার দিয়াছে এই অন্যায় ব্যবস্থা বন্ধ করিবার। অথচ বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ বা প্রশাসন স্থানীয় গ্রামীণ সমাজের রাজনীতির সহিত অঙ্গাঙ্গি যুক্ত থাকে, অন্তত সেই সমাজের বাহিরে নিরপেক্ষভাবে কাজ করিতে অপারগ হয়। তেমন ক্ষেত্রে কিন্তু বিচারবিভাগের শত শুভবোধ সত্ত্বেও সামাজিক সংকীর্ণতা রোধের কাজটি সহজ হইবে না।

আশঙ্কাটি জোরদার। সাধারণ পর্যবেক্ষণই বলিয়া দেয় যে, সাম্প্রতিক অতীতে সমান্তরাল বেআইনি বিচারের সংগঠনগুলির বর্ধমান মহাপরাক্রমের কারণটিই হইল তাহাদের পিছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বৃদ্ধি। এই কারণেই কয়েক বৎসর যাবৎ উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য অর্থাৎ বিজেপি-শাসিত গোবলয় হইতে বহু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার খবর আসিয়াছে। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহারে খাপ পঞ্চায়েতের দৌরাত্ম্যে বিবাহবিচ্ছেদ, ব্যক্তিনিগ্রহ, এমনকী আত্মঘাতের খবরও শোনা গিয়াছে। খাপ পঞ্চায়েতের টিকিটি কাহারও ছুঁইবার সাহস হয় নাই, কেননা গ্রামীণ সমাজের অনুমোদনক্রমে এই সংগঠনগুলির উপর নিষেধের বাড়াবাড়ি করিলে গোটা গ্রামীণ গোষ্ঠীর ভোটই হাতছাড়া হইবার আশঙ্কা। সুতরাং আশ্চর্য এক প্যাঁচে গণতান্ত্রিক রাজনীতিই আবার গণতান্ত্রিক আদর্শগুলির কণ্ঠরোধ করিতে বসিয়াছে। এই দিক হইতে ভারতের সমাজ সত্যই বেশ আলাদা রকমের। যত দিন এখানে গোষ্ঠী-সম্প্রদায় ইত্যাদির স্বাধীনতা হইতে ব্যক্তি-নাগরিক স্বাধীনতাকে পৃথক করার কাজটি অবহেলিত হইবে, তত দিনই গণতন্ত্রের অন্তর্ঘাত এভাবেই ঘটিবে। আদালতের কড়া অবস্থান ও আইন-বিচারের ভয় এই দুষ্টচক্র ভাঙিতে পারে কি না, দেখা যাক।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement