সম্পাদকীয় ২

প্রতীকী প্রতিবাদ

এক বার প্রদত্ত হইলে, সেই সম্মান প্রত্যর্পণ কি সম্ভব? প্রশ্নটি গুরুতর। প্রাসঙ্গিকও বটে। দিল্লি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে বলা হইয়াছে, যে হেতু সাহিত্য অকাদেমির সংবিধানে পুরস্কার ফেরত লইবার কোনও সংস্থান নাই, সে হেতু এই সংক্রান্ত কোনও সরকারি নির্দেশিকাও অপ্রয়োজনীয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

এক বার প্রদত্ত হইলে, সেই সম্মান প্রত্যর্পণ কি সম্ভব? প্রশ্নটি গুরুতর। প্রাসঙ্গিকও বটে। দিল্লি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে বলা হইয়াছে, যে হেতু সাহিত্য অকাদেমির সংবিধানে পুরস্কার ফেরত লইবার কোনও সংস্থান নাই, সে হেতু এই সংক্রান্ত কোনও সরকারি নির্দেশিকাও অপ্রয়োজনীয়। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৫ সালে। নরেন্দ্র মোদী দিল্লির মসনদে অধিষ্ঠিত হইবার পরে এক নূতন অসহিষ্ণু ভারত তখন দ্রুত আত্মপ্রকাশ করিতেছে। উপর্যুপরি কন্নড় সাহিত্যিক এম এম কালবুর্গির হত্যা এবং উত্তরপ্রদেশের দাদরি হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে ওই বৎসরের শেষার্ধ হইতেই দেশ জুড়িয়া সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপকরা অনেকেই তাঁহাদের পুরস্কার ফিরাইতে শুরু করেন। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সেই সময় একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হইয়াছিল। বক্তব্য ছিল, পুরস্কার ফিরাইবার হিড়িকে দেশের ভাবমূর্তি ভূলু্ণ্ঠিত হইতেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রের কোনও নির্দিষ্ট নির্দেশিকাও নাই। সুতরাং, অবিলম্বে একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হউক। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই দিল্লি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়। রায়ে স্পষ্ট হইল যে, পুরস্কার দিবার পর তাহা ফেরত লইবার অধিকার সাহিত্য অকাদেমির নাই। অন্তত আইনের চোখে।

Advertisement

কিন্তু আইনের এক্তিয়ার যেখানে শেষ হয়, তাহার পরেও এক বৃহত্তর পরিসর পড়িয়া থাকে। সেখানে দাঁড়াইয়া বলা যায়, পুরস্কার প্রত্যর্পণ এক রকম প্রতিবাদ— বিশেষ রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর উসকানিতে দেশে ক্রমশ বাড়িতে থাকা অসহিষ্ণুতা ও হিংসার বিরুদ্ধে। সমগ্র ঘটনায় সাহিত্য অকাদেমি-র আশ্চর্য নীরবতার বিরুদ্ধেও। সুতরাং, অকাদেমি-র টনক নড়াইতে এবং সরকারকে বার্তা দিতে সমাজের সাংস্কৃতিক পরিসরের উচ্চ স্তরটির এক সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল। শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাহাই করিয়াছিলেন। পন্থাটি নূতন নহে। ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘নাইটহুড’ ত্যাগের কারণ ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড। অনেকটা একই ভাবে প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন ভিয়েতনামের কূটনীতিবিদ লে দুক থো। দেশে শান্তি ফেরে নাই বলিয়া ১৯৭৩ সালে শান্তির নোবেল প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন তিনি। সুতরাং, এমন অন্য ধারার প্রতিবাদের তালিকা দীর্ঘ। প্রতিবাদ জানাইতে হইলে, সম্মাননীয় ব্যক্তির নিকট যাহা সর্বাপেক্ষা মূল্যবান, সেই সম্মানই তিনি হয় ফিরাইবেন, নয়তো লইতে অস্বীকার করিবেন। ইহাই স্বাভাবিক।

কিন্তু একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। সম্মান তো কোনও বস্তু নয়, যে তাহাকে ফেরত দিবার সংস্থান থাকিবে। যাঁহাকে সম্মান জানানো হইল, তিনি সম্মান লইতে অস্বীকার করিতে পারেন। কিন্তু ফেরত দিতে পারেন কি? এক অর্থে, পারেন। কারণ, সম্মান শুধুমাত্র মৌখিক ভাবে প্রদত্ত হয় না। অর্থ, পদক, মানপত্র-সহ তাহার নানা প্রতীক, যাহার মধ্য দিয়া সম্মাননীয়কে সম্মান জানানো হয়। প্রতীক যদি সম্মান জানানোর উপায় হইতে পারে, তাহা হইলে সেটি প্রতিবাদের উপায়ও বটে। এ ক্ষেত্রে সম্মান প্রদান এবং ফেরত— উভয়ই প্রতীকের খেলা। সুতরাং, মহামান্য আদালতের বিচার শিরোধার্য করিয়াও বলিতে হয়, যে সময় এবং উদ্দেশ্য লইয়া অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপকরা তাঁহাদের সম্মান ফিরাইয়াছেন, তাহা যথার্থ। এই প্রতিবাদ বিস্মৃত হওয়া উচিত নহে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement