জীবনের শেষ চৌদ্দটি মাস বাদ রাখিলে যিনি আগাগোড়া ভারতের নাগরিক, তাঁহাকে কি বিনা প্রশ্নে ‘বিদেশি’ বলিয়া দাগিয়া দেওয়া যায়? এমনকী, তিনি সেই ‘বিদেশ’-এর জনক হিসাবে স্বীকৃত হইলেও? মহম্মদ আলি জিন্নার প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটি উঠিবেই। অবশ্য, তাহার উত্তর খুঁজিবার দায় বিজেপির নাই। দেশভাগের পূর্বে, এমনকী পাকিস্তান প্রস্তাবের পূর্বেও যে ভারতীয় রাজনীতিতে জিন্নার তাৎপর্য ছিল, সেই ইতিহাস যে কোনও মতেই অস্বীকার করা যায় না, বিজেপি সেই আলোচনায় ঢুকিতেই নারাজ। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির দেওয়ালে কেন জিন্নার ছবি ঝুলিবে, সেই প্রশ্নটি লইয়া তাহারা বাজার গরম করিতেছে। উত্তরপ্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী জিন্নাকে জাতির শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করিয়াছেন। যে পাকিস্তানকে বিজেপি ‘শত্রু’ জ্ঞান করে, জিন্না সেই দেশটির জনক হিসাবে স্বীকৃত বলিয়াই ভারতের শত্রু, বিজেপির যুক্তি যদি এই পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তাহার সহিত তর্ক অবান্তর। কিন্তু, শত্রুতার উৎস যদি দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং দেশভাগ হয়, তবে তাহার যৌক্তিক পরিণতির সন্ধান করিলে নাগপুরের মুখ পুড়িবে। হিন্দু ও মুসলমানকে দুইটি পৃথক এবং অ-মিলসম্ভব জাতি হিসাবে চিহ্নিত করিবার ঐতিহাসিক দায় জিন্নার যতখানি, সাভারকর বা গোলওয়ালকরের দায় তাহার তুলনায় বেশি বই কম নহে। বস্তুত, ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ঐতিহ্যটি মূলত বহন করিয়া চলিয়াছে যাহারা, তাহাদের প্রত্যেকেরই শিক়ড় নাগপুরে। অতএব, জিন্না কেন শত্রু, এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজিতে বসিলে আদিত্যনাথদের আত্মদর্শন হইবার সম্ভাবনা।
জিন্নার ছবি আছে মানেই তিনি প্রতিষ্ঠানের সকল ছাত্রের আদর্শ, ইহা অতিসরলীকরণেরও বাড়া। ছবিটির উপস্থিতি একটি স্বীকৃতিমাত্র— ইতিহাসের স্বীকৃতি। কিন্তু, কোনও ভারতীয়ের নিকট কি জিন্না আদর্শ হইতে পারেন? কমিউনিস্ট পার্টি যদি লেনিন কিংবা মাওকে আদর্শ জ্ঞান করিতে পারেন আর নরেন্দ্র মোদীর উপাস্য যদি হন লি কুয়ান ইউ, তবে জিন্নাকে আদর্শ মানিবার গণতান্ত্রিক অধিকার ভারতীয় নাগরিকের থাকিবে না কেন? কেহ বলিতে পারেন, জিন্না প্রকৃত প্রস্তাবে আলিগড়ের ছাত্রদের, বা দেশের বৃহত্তর মুসলমান সমাজের ক্ষতিই করিয়াছেন। অবিভক্ত ভারতের মুসলমান সমাজের সার্বিক সমর্থন তিনি কখনও পান নাই। তবুও, ধর্মের ভিত্তিতেই দেশভাগ করিয়া তিনি ভারতে মুসলমানদের শুধু ঘোর সংখ্যালঘুতে পরিণত করেন নাই, চিরন্তন ‘অপর’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু ইহা ইতিহাসের একটি পাঠমাত্র। আলিগড়ের ছাত্ররা সেই পাঠটিকেই গ্রহণ করিবেন কি না, সিদ্ধান্ত তাঁহাদের। গ্রহণ করিলেও, জিন্নার ছবি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে থাকিবে কি না, সেই সিদ্ধান্তও। সে বিষয়ে রায় দেওয়ার, অথবা সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দেওয়ার অধিকার বিজেপির নাই। তাহা গা-জোয়ারি।
ভারতীয় রাজনীতিতে এই গা-জোয়ারিই দস্তুর। ইতিহাসের চিহ্নগুলির অপনয়নই রাজনীতির উপজীব্য হইয়া উঠিয়াছে। লেনিন হইতে অম্বেডকর, গাঁধী হইতে পেরিয়ার, একের পর এক মূর্তি আক্রান্ত হইতেছে। ইতিহাসের এই বহুত্বের সম্মুখীন হইবার জোর নাগপুরের রাজনীতির নাই বলিয়াই। অবশ্য, এই দোষে কেবল হিন্দুত্ববাদীরাই দুষ্ট নহে। জাতীয়তাবাদী আবেগ তীব্র হইয়া উঠায় পশ্চিমবঙ্গের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বামফ্রন্ট সরকার কলিকাতা হইতে ঔপনিবেশিক আমলের প্রায় সব মূর্তিভাস্কর্য সরাইয়া দেয়। যেন তাহাতেই দুই শত বৎসরের পরাধীনতার ইতিহাস মুছিয়া যাইবে! ইতিহাসবোধের অভাব ভারতীয় রাজনীতির অভিজ্ঞান। লোকসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়িয়াছে। এই সময় বিজেপি সেই অভাবকে রাজনীতির পাঁকাল মাছ ধরিবার কাজে ব্যবহার করিতে চাহিতেছে, আলিগড় কাণ্ডের ইহাই মূল কথা।