ক্ষমতা প্রয়োগের প্রকরণ আর কৌশলে বিরাট পরিবর্তন এসেছে

লোকের চোখে ধুলো দিয়ে

আসলে ভারতের রাজনীতিতে কেন্দ্র আর রাজ্য, এই দু’টি স্তরের পৃথক অস্তিত্ব বরাবরই ছিল।

Advertisement

পার্থ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

নিরঙ্কুশ: রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের পক্ষে কথা বলছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, দিল্লি, ১১ ডিসেম্বর। পিটিআই

দু’টি মানচিত্র পাশাপাশি। একটিতে দেখা যাচ্ছে ভারত, মার্চ ২০১৮, অন্যটিতে ভারত, ডিসেম্বর ২০১৯। পূর্ব উপকূল ধরে এক চিলতে সাদা অংশ বাদ দিলে প্রথম মানচিত্রের রং সবটাই গেরুয়া। দ্বিতীয়টিতে আবার উত্তর, উত্তর-পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণে কয়েকটি গেরুয়ার ছিটে, বাকি ভূখণ্ডের সবই সাদা। বছর দেড়েকের মধ্যে এ যেন নাটকীয় পরিবর্তন। অথচ দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা থেকে তা বোঝা যাচ্ছে কি? কেন্দ্রের শাসক-নেতাদের হাবভাব দেখলে মনে হবে তাঁরাই দেশের একচ্ছত্র অধিপতি। এই বৈপরীত্যের কারণ কী?

Advertisement

আসলে ভারতের রাজনীতিতে কেন্দ্র আর রাজ্য, এই দু’টি স্তরের পৃথক অস্তিত্ব বরাবরই ছিল। অনেক সময় সেই পার্থক্য প্রচ্ছন্ন থেকেছে, মাঝে মাঝে প্রকট হয়েছে। ১৯৫৬ থেকে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের প্রক্রিয়া দানা বাঁধার পর যত দিন কেন্দ্র-রাজ্য দুই স্তরেই কংগ্রেস আধিপত্য বজায় ছিল, তত দিন বড় প্রভেদ চোখে পড়েনি। ১৯৬৭-তে বিভিন্ন রাজ্যে অকংগ্রেসি সরকার গঠনের পর কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত শুরু হয়। ১৯৭১-এর পর ইন্দিরা আমলে ভারসাম্য সরল কেন্দ্রের দিকে, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রশক্তির পরাক্রমে রাজ্য স্তরের স্বাতন্ত্র্য ঢাকা পড়ে গেল। ১৯৭৭-এর নির্বাচনে দেখা গেল, উত্তর আর দক্ষিণ ভারতের মানুষ বিপরীত দিকে ভোট দিয়েছেন। রাজীব গাঁধীর সরকার নির্বাচিত হয়েছিল বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। কিন্তু অপ্রতিহত ক্ষমতার দম্ভের সামনে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল এন টি রামা রাওয়ের তেলুগু দেশম। তার পর কিছু দিন কেন্দ্র আর রাজ্য স্তরের ফারাকটা যথেষ্ট কার্যকর ছিল। সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস যখন দুর্বল হতে শুরু করল, তখন এমনটাই মনে হয়েছিল যে একাধিক রাজ্য স্তরের দলের সমর্থন ছাড়া কেন্দ্রে কোনও সরকার গঠন করা যাবে না। ২০১৪’র নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার তৈরির সময় তারা সহযোগী রাজ্য স্তরের দলগুলিকেও মন্ত্রিসভায় নিয়েছিল।

পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল যখন বিজেপি এক এক করে বিভিন্ন রাজ্যে, কোথাও একক ভাবে, কোথাও জোট বেঁধে, কোথাও বিপক্ষের বিধায়ক ভাঙিয়ে, সরকার গড়তে শুরু করল। এক সময় দেখা গেল, মাত্র আটটি বাদ দিয়ে একুশটি রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে।

Advertisement

অথচ বিভিন্ন রাজ্যে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যেও, বিরোধী আন্দোলন কিন্তু থামেনি। জাঠ-গুজ্জর-পতিদার প্রভৃতি একদা প্রভাবশালী কৃষিনির্ভর জাতি হইচই শুরু করে দিল এই বলে যে তাদের জন্যেও সরকারি চাকরি আর শিক্ষায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত ছাত্রদের বিক্ষোভ দেখা গেল। সবচেয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হল রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের ঋণ মকুবের দাবি নিয়ে। রাজ্য নির্বাচনের কথা ভেবে কৃষিঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হয়।

তা সত্ত্বেও ২০১৮-র শেষে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তীসগঢ়ে বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হল। ২০১৯-এর শেষে হরিয়ানাতে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না রাখতে পেরে চৌটালার সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার বানাল। মহারাষ্ট্রে দীর্ঘ দিনের জোটসঙ্গী শিবসেনার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সেখানেও ক্ষমতা হাতছাড়া হল। অতঃপর ঝাড়খণ্ডে হার। রাজ্য রাজনীতি বিচার করলে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরে বিজেপি একনাগাড়ে নির্বাচন হেরেছে। সে দিক দিয়ে দেখলে, এপ্রিল-মে মাসের লোকসভা নির্বাচন একটা বিরাট ব্যতিক্রম। অথচ সেটাই দেশের সামগ্রিক রাজনীতির চরিত্র নির্ধারণ করে দিচ্ছে। কী করে এমন হল?

মোদী সরকারের দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্ষমতা প্রয়োগের প্রকরণ আর কৌশলে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। তার কিছু কিছু হয়তো আগের পর্বে শুরু হয়েছিল, কিন্তু স্পষ্ট হয়নি। পরিবর্তিত কৌশলের দুটো উদ্দেশ্য। এক, কেবল সরকারি অথবা রাজনৈতিক মহলেই নয়, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র, যেমন ব্যবসা, শিক্ষা, সংবাদমাধ্যম, বিনোদন, সর্বত্র কেন্দ্রীয় সরকার আর বিজেপি নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করা। তা করতে গিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রলোভন আর সিবিআই-আয়কর বিভাগকে লেলিয়ে দেওয়ার ভয়, দু’রকম কায়দাই ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে প্রকাশ্য বিরোধিতার মাত্রা আর ঝাঁজ কমে গিয়ে প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, সঙ্ঘ-পরিবারের আদর্শগত দিশা, অর্থাৎ হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাকে বাস্তবায়িত করা। হিন্দি ভাষায় রাষ্ট্র শব্দের অর্থ নেশন। সাভারকর-গোলওয়ালকরের কল্পনায় হাজার হাজার বছর ধরে ভারত হল হিন্দু নেশনের পিতৃভূমি। এ বার প্রয়োজন সেই রাষ্ট্র বা নেশনকে তার নিজস্ব রাজ্য বা স্টেট-এর বাস্তব রূপ দেওয়া। সেই নেশন-স্টেট সাবেক হিন্দুস্তান নয়, আধুনিক হিন্দুস্তান।

এই দুই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ক্ষমতার প্রকরণে যে মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা হল সংবিধান আর আইনব্যবস্থাকে নিছক রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। এমন ঘটনা ঘটত জরুরি অবস্থার সময়। কিন্তু কোনও ইমার্জেন্সি জারি না করে আইন আর সংবিধানকে রাজনীতির স্বার্থে যথেচ্ছ ব্যবহার করার এমন কদর্য নিদর্শন আগে দেখা যায়নি। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করার জন্য আইন নিয়ে যা সব প্যাঁচপয়জার কষা হল, তা দেখে সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। প্রতিবাদের সুযোগটুকুও রাখা হল না। কাশ্মীরে মাসের পর মাস ব্যবসা, শিক্ষা, অফিসকাছারি, পত্রপত্রিকা সব বন্ধ, তাতে বাকি ভারতবাসীর কী এসে যায়? বিজেপি নেতারা বীরদর্পে ঘোষণা করলেন, ‘দেখলে তো, বলেছিলাম ৩৭০ ধারা তুলে দেব, দিলাম! কেউ পারল ঠেকাতে?’

একই রকমের ঔদ্ধত্য দেখা গেল বেআইনি কার্যকলাপ নিরোধক আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে। নতুন আইনে কেবল সংগঠন নয়, যে কোনও ব্যক্তিকে সন্দেহের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করে আটক করা যাবে। বিরোধীরা লোকসভায় অল্পবিস্তর আপত্তি করল বটে, কিন্তু কে শোনে কার কথা? কেবল লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরই বা বলি কী করে? অযোধ্যা মামলায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যের বিচারে জমির মালিকানার নিষ্পত্তি করা হল— তাতে সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতিদের রায়ও সহায় হল। হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডিত্যপূর্ণ রায়ের নীচে রচয়িতা বিচারপতি নিজের নামটা দিলেন না। সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এই প্রথম এমন ঘটল।

লোকের চোখে ধুলো দিয়ে কাজ গুছিয়ে নেওয়ার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন। ১৯৫৫ সালের আইনে চারটি উপায়ে নাগরিক হওয়ার কথা বলা আছে। জন্মসূত্রে, উত্তরাধিকারসূত্রে, রেজিস্ট্রেশন মারফত এবং ন্যাচারালাইজ়েশন বা স্বাভাবিকীকরণের ফলে ভারতের নাগরিক হওয়া যায়। ১৯৮৬-র অসম চুক্তির ফলে শুধুমাত্র অসমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাগরিকত্বের কতকগুলো বিশেষ ধারা জোড়া হল। সেই সূত্রে অসমে এনআরসি অর্থাৎ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার প্রসঙ্গ ওঠে। ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকারের আমলে ওই আইনে প্রথম ইললিগাল ইমিগ্রান্ট, অর্থাৎ বেআইনি আগমনকারীর কথা উল্লেখ করা হয়। ২০০৫ সালে কংগ্রেসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদম্বরম সারা ভারতে নাগরিক পঞ্জি তৈরি করা আর প্রত্যেককে জাতীয় আইডেনটিটি কার্ড দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু আধার কার্ডের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ায় সেই প্রস্তাব চাপা পড়ে যায়।

অসমে এনআরসি-তে উনিশ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েছেন, যার মধ্যে বারো লক্ষ হিন্দু। নিজেদের সমর্থকদের কাছে মুখরক্ষার জন্য বিজেপি নেতারা তখন সিএএ-এনআরসি-র জোড়া কৌশল ভেবে বার করলেন। সঙ্ঘ পরিবার এত দিন যা দাবি করত, তা আইনসিদ্ধ হল। হিন্দু আগন্তুক শরণার্থী, অতএব নাগরিক হওয়ার দাবিদার। মুসলিম আগন্তুক মাত্রেই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী, অতএব তার ধর্মের কারণেই সে ভারতের নাগরিক হওয়ার অযোগ্য।

বিরোধী দলেরা এখন যে যা-ই বলুক, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গোড়া থেকে যথেষ্ট সরব হলে সংসদে এই আইন অত সহজে পাশ করা যেত না। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে যে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, বিরোধীরা তখনও তার প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। সত্যিকারের প্রতিবাদ এল ছাত্রমহল থেকে। বিজেপি মহলে এখন শোনা যাচ্ছে, সিএএ-এনআরসি অস্ত্র শানানো হয়েছিল অসম আর পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ করার জন্য। তার ফলে যে সারা দেশে এমন উত্তাল পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা আদৌ ভাবা যায়নি। মুখে যা-ই বলুন, বিজেপি নেতারাও আজ বুঝছেন যে প্রতিবাদ কেবল তিন-চারটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেয়াদব ছাত্রছাত্রী, হাতে-গোনা কিছু শহুরে নকশাল আর

মুসলিম বদমাশদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মানুষের ভয় ভেঙেছে। (চলবে)

ইতিহাসবিদ এবং প্রাক্তন অধিকর্তা, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন