তরাই-ডুয়ার্স: জঙ্গল, বন্যপ্রাণ আর নদীর জীবন্ত ক্যালেন্ডার!

দু’পা অন্তর নদীর সঙ্গে দেখা। জঙ্গল কোথাও দিনেই অন্ধকার, আবার কোথাও সবুজ আলোয় মাখা। পর্যটকের কাছে ডুয়ার্স চিরন্তন হাতছানি। লিখছেন রত্না রায়জয়ন্তী থেকে যাওয়া যায় বক্সা। বক্সায় যে দুর্গ  ছিল এক সময়, অধুনা  ধ্বংসস্তূপে পরিণত সেই দুর্গে এক সময় অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দিজীবন কাটিয়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:০৬
Share:

আলিপুরদুয়ার শহর থেকে ডুয়ার্স ভ্রমণে যাওয়া সব চেয়ে সুবিধার। ডুয়ার্সের আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যস্থল বক্সা ও জয়ন্তী আলিপুরদুয়ার থেকে খুব কাছে। আগে জয়ন্তী যেতে হলে ট্রেনে রাজাভাতখাওয়ার গভীর অরণ্যের মাঝখান দিয়ে যেতে হত। হাতিদের চলাচলের রাস্তার উপর দিয়ে রেল যাওয়াতে অনেক সময় হাতিরা রেলে চাপা পড়ে মারা যেত। এখনও যায়। তবে, সংখ্যাটা কমেছে। ডুয়ার্সের মধ্য দিয়ে চলা রেল-রাস্তা এখন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গন্তব্যে পৌঁছে গেলে নদী, পাহাড় আর বনে ঘেরা জয়ন্তীর সৌন্দর্য অতুলনীয়। না দেখলে সে শোভা বোঝানো সম্ভব নয়। প্রকৃতি তার সম্পূর্ণ রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে নিজেকে সাজিয়ে পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে! দুর্দম সে টান!

Advertisement

জয়ন্তী থেকে যাওয়া যায় বক্সা। বক্সায় যে দুর্গ ছিল এক সময়, অধুনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত সেই দুর্গে এক সময় অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। বক্সা আগেও যেমন দুর্গম পথ ধরে যেতে হত, এখনও পথ প্রায় তেমনই দুর্গম। ঘন অরণ্যে ঢাকা দুই পাশ। মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে বক্সা যাওয়ার রাস্তা। দিনের বেলাও গা ছমছমে ভাব। বন্য পশুর আক্রমণের ভয় তো আছেই; তা ছাড়া ডাকাতি, ছিনতাইয়েরও আশঙ্কা হয়। আগে বক্সা জঙ্গলে ঢোকার আগে ভাবতে হত। কিন্তু ভ্রমণপিপাসুদের অবশ্য অত ভয় করলে চলে না। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার আগ্রহ যাঁদের রক্তে, তাঁরা শত শত, হাজার হাজার দুর্গম পথের পথিক। কাজেই, ডুয়ার্স ভ্রমণে বেরিয়ে

জয়ন্তী আর বক্সা না গিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন কী করে!

Advertisement

জয়ন্তী থেকে যাওয়া যায় ভুটানঘাট। হাতিপোতা হয়ে ভুটানঘাট এখনও পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট। তবে শীতের সময়টা বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে। কারণ, কমলালেবু। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানের কমলালেবুতে শিলিগুড়ি ছেয়ে থাকে। শিলিগুড়িতে শীতের সময় গেলে দোকানিদের হাঁকডাকেই বোঝা যায়, ভুটানের কমলার কত কদর!

ডুয়ার্স বললে শুধু এটুকুতেই শেষ হয় না! ডুয়ার্স মানে তিস্তা, কালজানি, রায়ডাক, সঙ্কোশ, তোর্সা, জলঢাকা, তুরতুরি, লিস, ঘিস, চেল, জর্দা— সুন্দর সব নামের নদী! ডুয়ার্স মানে নাগরাকাটা! ডায়না নদীর কোলে বানারহাট, মেটেলি, বীরপাড়া-চা-বাগান। সান্তারাবাড়ি, মাদারিহাট হয়ে জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। হাতি, গন্ডার, গাউর! তবে, ভাগ্য প্রসন্ন না হলে তাদের ছবি দেখেই খুশি হতে হয়!

জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে বেড়াতে গিয়ে হাতি সাফারি করেননি, এমন পর্যটক কমই আছেন। এ ছাড়া আছে গরুমারা ফরেস্ট আর গরুমারা-লাগোয়া মূর্তি নদী। এখানে হাতিরা দল বেঁধে জল খেতে আসে। চিলাপাতা ফরেস্ট, মহানন্দা অভয়ারণ্য, গয়েরকাঁটা, নিমতিঝোরা, চাপড়ামারি। খুনিয়া মোড় বলে চাপড়ামারির মুখে একটি ক্রসিং আছে। নাম শুনলেই গা ছমছম করে! নিশ্চয়ই এখানে পর্যটকদের খুন করে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকত দুষ্কৃতীরা! তা ছাড়া এই খুনিয়া মোড়ে দাঁতাল-হাতিদের মুখে পড়ার ভয়ও আছে। তবে, ভ্রমণপিপাসুদের অত ভয় পেলে চলে না। অনেক পর্যটকই গাড়ি দাঁড় করিয়ে খচাখচ বুনো হাতিদের ক্যামেরাবন্দি করে থাকেন। তাতে ভয় যেমন আছে, উত্তেজনাও তেমন কম নেই মোটে!

ডুয়ার্সের টোটো জনজাতি এখন সর্বজনপরিচিত। বন্য জন্তু জানোয়ারদের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করে এঁরা বেঁচে আছেন। আছেন আরও অনেক জনজাতির মানুষ। দরিদ্র, কিন্তু নির্ভীক, কর্মঠ, সৎ। মূল স্রোতে আসতে আগ্রহী, কিন্তু নিজেদের ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ না করে। বর্তমানে সরকার থেকে এই জনজাতিগুলির জন্য নানা উন্নয়নের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করাও হয়েছে। ক্রমে এই জনজাতিগুলি উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলেছে। মাদারিহাট হয়ে টোটোপাড়ায় পৌঁছতে হয়। ভুটানের ফুণ্টশিলিংয়ের থেকে খুব বেশি দূরে নয়। অনেকে এঁদের সঙ্গে দেখা করে, কথা বলে, এঁদের জীবনধারণের পদ্ধতিকে লোকসমাজে তূলে ধরেন আর এই প্রচারের মাধ্যমেই নানা সাহায্য পৌঁছে যায় ওঁদের কাছে।

তরাই-ডুয়ার্সের কথা বলতে গেলে আলগোছে উল্লেখ করতেই হয় সেবকের কথা। তরাই-ডুয়ার্স মানে সেবক ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে চলা তিস্তার সবুজ-নীলের উদ্দাম স্রোতে অতল জলের আহ্বানও বটে! তাকে ভুলে গেলে চলবে কী করে! (শেষ)

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন